ফেনী জেলার পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, এবং ফুলগাজী উপজেলার দুর্গম গ্রামগুলোতে বন্যার পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় এসব এলাকার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য প্রশাসন ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা চালানো হলেও দুর্গম গ্রামগুলোতে ত্রাণ পৌঁছাতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সড়কপথগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার ফলে ত্রাণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যার কারণে স্থানীয়দের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।
ত্রাণ সংকট:
বন্যাকবলিত গ্রামগুলোতে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অনেক গ্রামে পানের জন্য সুপেয় পানি নেই, আর এই সংকট দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কাও বাড়ছে। পাশাপাশি, খাদ্যেরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বহু মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ভুগছে। যেসব এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে, সেখানেও সরবরাহ সীমিত এবং অনেক সময় মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় তা অপর্যাপ্ত।
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপর্যয়:
দুর্গম গ্রামগুলোতে ত্রাণ পৌঁছানো এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যার কারণে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, যার ফলে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযোগও কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে উদ্ধারকাজ ও ত্রাণ কার্যক্রম চালানো আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। নৌযানের অভাবের কারণে অনেক এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে থাকার কারণে সড়কপথেও ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।
জরুরি সেবা ব্যাহত:
বন্যার কারণে এলাকার হাসপাতাল, ব্যাংকসহ জরুরি সেবাগুলো সম্পূর্ণরূপে অচল হয়ে পড়েছে। এতে করে মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যার ফলে অসুস্থদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটছে। হাসপাতালের পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে চিকিৎসা সেবা কার্যত বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে, গর্ভবতী নারী, শিশু, ও বয়স্করা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া, ব্যাংকিং সেবা বন্ধ থাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে।
আশ্রয়কেন্দ্রের দুর্দশা:
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, তবে সেখানেও ত্রাণের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। খাবার, পানি, এবং চিকিৎসা সামগ্রীর অভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষগুলোর দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। শিশুদের জন্য উপযুক্ত খাবার ও দুধের অভাব তাদের আরও দুর্দশায় ফেলেছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ বাধ্য হয়ে দূষিত পানি পান করছে, যা থেকে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে।
ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয়হীনতা:
ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় সমন্বয়হীনতার অভিযোগও পাওয়া গেছে। মাঠ পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবকরা জানিয়েছেন, ত্রাণ কার্যক্রমে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, যার ফলে অনেক জায়গায় ত্রাণ পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। তাছাড়া, ত্রাণ বিতরণের সময়ও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকদের। যেসব এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না, সেসব এলাকায় অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় দ্রুত ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে এবং যেসব এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি, সেসব এলাকায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি, দুর্গত এলাকার মানুষদের জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে, পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটবে এবং এর ফলে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়তে পারে।
পরিস্থিতি এখনও সংকটাপন্ন:
যদিও নোয়াখালীসহ অন্যান্য অঞ্চলে পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে, ফেনী জেলার অবস্থা এখনও সংকটাপন্ন। বন্যার পানি এখনও নামেনি, এবং ত্রাণের অভাব ও বিশুদ্ধ পানির সংকট স্থানীয়দের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলছে। প্রশাসনকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ পৌঁছানো যায় এবং মানুষদের দুর্ভোগ কমানো যায়।
ফেনীসহ আশপাশের অঞ্চলে অবস্থিত দুর্গত মানুষদের বাঁচাতে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে, এখনই প্রয়োজন দ্রুত এবং সমন্বিত ত্রাণ কার্যক্রম।