ফাহিম মুনতাসীর
কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দর দেশের অন্যতম ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে পণ্য খালাস, পরিবহন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে শ্রমিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বন্দর এলাকায় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, একটি নির্দিষ্ট পরিবার শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সাধারণ শ্রমিকদের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে।
এদিকে
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বন্দরের শ্রমিক নেতা আবুল কালাম আজাদ (বাবুল) এক সহকর্মীর হামলায় আহত হন। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ শ্রমিক আব্দুর রহিম তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। বাবুলের ওপর হামলার ঘটনার পর বন্দরে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায় এবং শ্রমিকদের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বন্দরের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট (রেজি. নং চট্টগ্রাম ২৪৩১) এবং শ্রমিক ফেডারেশন (রেজি. নং চট ২৪)—এই দুই সংগঠনের নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্দিষ্ট পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত। বর্তমান সভাপতি সাইদ আহমেদ সুজন, সহ-সভাপতি ফুলমিয়া, সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো সেই পরিবারের ঘনিষ্ঠদের দখলে। শ্রমিকদের অভিযোগ, এই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের ফলে তারা ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং সংগঠনের যে কোনো বিরোধিতার মুখে হুমকির শিকার হচ্ছেন।
শ্রমিকদের প্রধান অভিযোগ হলো
১. সংগঠনের একক নিয়ন্ত্রণ – শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব কয়েকজন প্রভাবশালীর হাতে কেন্দ্রীভূত। ফলে সাধারণ শ্রমিকদের মতামত উপেক্ষিত হচ্ছে।
2. অবৈধ শ্রমিকদের আধিপত্য – বন্দরে রেজিস্ট্রেশনবিহীন শ্রমিকরা কাজ করছে, যারা মূলত ক্ষমতাসীন শ্রমিক নেতাদের ছত্রছায়ায় রয়েছে।
3. রাজনৈতিক প্রভাব – অভিযোগ রয়েছে, শ্রমিক সংগঠনের বর্তমান নেতৃত্ব একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের সমর্থনে তাদের একক আধিপত্য কায়েম করেছে। এর ফলে বিকল্প নেতৃত্ব বিকাশের কোনো সুযোগ নেই।
4. শ্রমিক নির্যাতন ও হামলা – সংগঠনের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই শ্রমিকদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন নেমে আসে। বাবুলের ওপর হামলার ঘটনাটি তার অন্যতম উদাহরণ।
এমতাবস্থায়
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বন্দরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তিরা মূলত আব্দুর রহিমের ঘনিষ্ঠজন। ফলে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট (রেজি. নং ২৪৩১) এবং শ্রমিক ফেডারেশন (রেজি. নং চট ২৪) – এই দুটি সংগঠনের কার্যক্রম ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়া, শ্রমিকদের মধ্যে “লেবার সেটিং” নিয়েও বড় ধরনের মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ফরওয়ার্ডিং ক্লিয়ারিং শ্রমিকদের অনেকে অবৈধভাবে কাজ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ পরিস্থিতিতেগত ৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার
বিবিরবাজার লোড আনলোড শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি. নং কুম ৮৪) সভাপতি মো. সাকিরুল ইসলাম কুমিল্লা শ্রম অধিদফতরের উপ-মহাপরিচালক মো. মনিরুজ্জামানের বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি বন্দরের শৃঙ্খলা ফেরাতে লোড আনলোড ফেডারেশন (রেজি. ২৪) এবং ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং (রেজি. নং ২৪৩১) এর রেজিস্ট্রেশন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
সাধারন শ্রমিকদের দাবি, শ্রমিক সংগঠনগুলোকে পরিবারতান্ত্রিক শাসন থেকে বের করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে।
সঠিক রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে শ্রমিকদের চিহ্নিত করতে হবে এবং যারা অবৈধভাবে কাজ করছে, তাদের অনুমতি বাতিল করতে হবে।
শ্রমিক সংগঠনকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে এবং কোনো রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে
বাবুলের ওপর হামলার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
শ্রম অধিদপ্তরকে বন্দরের সার্বিক পরিস্থিতি তদন্ত করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
পরিশেষে
বিবিরবাজার স্থলবন্দরের শ্রমিক সংগঠন বর্তমানে নেতৃত্বের একক নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত। সাধারণ শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এবং সংগঠন বিরোধিতাকারীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
যদি অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তবে বন্দরে শ্রমিক অসন্তোষ আরও তীব্র হতে পারে, যা বন্দর কার্যক্রমকেও ব্যাহত করবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।