সমতট ডেক্স // শরিয়াভিত্তিক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) সিএসআর তহবিল থেকে সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের নামে টাকা নিয়ে কারসাজি করেন শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তিনি সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানও। আরাফাতের চাপে কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পাঁচ কোটি টাকা দেয় ব্যাংকটি। যুব উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করার জন্য অর্থ নিলেও বিভিন্ন ব্যাংকে এ টাকা জমা রেখে সময় সময় সুদ তুলে নিজের পকেট ভরেন আরাফাত। দুটো ব্যাংক থেকে সুদ বাবদ প্রায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা তুলে নেন। যদিও এসব টাকা যুব উন্নয়নের শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দকৃত। ইতিমধ্যে আরাফাতের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আমার দেশ অনুসন্ধানে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সিএসআর তহবিল থেকে সুচিন্ত ফাউন্ডেশনের নামে মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে পাঁচ কোটি টাকা দেওয়া হয়। কোনো প্রকার আবেদন ছাড়াই মৌখিক চাওয়াতে এ টাকা দিয়েছিল ব্যাংকটি। এক্ষেত্রে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৫৪তম বোর্ড সভায় অনুমোদন দেয়। ব্যাংকটি থেকে এ অর্থ নেওয়া হয় যুব উন্নয়নের শিক্ষা কার্যক্রম খাতে খরচ করার জন্য। যদিও কোনো অর্থ সেখানে ব্যবহার করা হয়নি। বরং পুরো টাকা ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট প্রথমে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর) করে রাখা হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন সময় সুদ আয় বাবদ নগদ মোট ৭৮ লাখ টাকা তুলে নেন আরাফাত। পরবর্তী সময়ে আসল পাঁচ কোটি টাকা তুলে আইএফআইসি ব্যাংকে এফডিআর করা হয়। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় সেখান থেকে প্রায় ৬৬ লাখ টাকা সুদ বাবদ তুলে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে টাকাগুলো নগদ উত্তোলন সুবিধা দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইএফআইসি ব্যাংকে থাকা পাঁচ কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব ব্লক করে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো সিএসআর তহবিল শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রশমন ও অভিযোজন খাতে এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আবার মোট সিএসআর ব্যয়ের ৫ শতাংশ অনুদান হিসেবে সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট তহবিলেও দেওয়ার নির্দেশনা ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ১০ বছরে দেশের ব্যাংকগুলো সিএসআর খাতে ব্যয় করেছে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই জমা দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিলে। আর সেই অর্থ দিয়ে মুজিববর্ষ উদযাপন, চলচ্চিত্র নির্মাণ, শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যদের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনের মতো আয়োজনও করা হয়েছে। কেবল মুজিববর্ষ উদযাপনের জন্যই শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টে অনুদান দেওয়া হয় ২২৭ কোটি টাকা। সিএসআরের অর্থ ব্যয় হয়েছিল মুজিবের জীবনী নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণেও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, ‘মন্ত্রী হওয়ার কারণে আবেদন কপি চাওয়া হয়নি। তারা এতটাই ক্ষমতাশীল ছিল যে, আবেদন কপি চাওয়ার সাহস হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশে এ অর্থ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নজরুল ইসলাম মজুমদার (সাবেক এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান) বিভিন্ন সময় শেখ হাসিনার তহবিলে টাকা দেওয়ার চাপ দিতেন। তার চাপে অনেক সময় যেসব মানুষকে সিএসআরের টাকা দেওয়া দরকার তাদের দেওয়া সম্ভব হয়নি। সিএসআরের টাকা মূলত অসহায় মানুষদের জন্য ব্যাংক দিয়ে থাকে।’
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএফআইইউ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের কাছে এই অর্থ কীভাবে দেওয়া হয়েছে এবং কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে তা জানতে চাওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ফোরকানউল্লাহ ব্যাংকটির সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট মাজহারুল হক সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
মাজহারুল হক আমার দেশকে বলেন, ‘এ ঘটনার সময় এমডি স্যার ও আমি কেউ হেড অফিসে ছিলাম না। তবে যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল কেউ এখন ব্যাংকে নেই। আমি আসার পর সমস্ত ফাইলপত্র খোঁজ নিলাম। সেখানে আবেদন পাওয়া যায়নি। তবে সুচিন্তা ফাউন্ডেশনকে দেওয়া টাকার সব কাগজপত্র পাওয়া গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে পাঁচ কোটি টাকা অনুমোদন করে পে-অর্ডার ইস্যু করে দেওয়া হয়। এরপর পে-অর্ডার ক্লিয়ার করে নিয়ে যায়। এখন অ্যাকাউন্ট ব্লক আছে। এটা আমাদের কাছে চলে আসবে এমন একটা প্রক্রিয়া চলছে। তবে এটা সিএসআর ফান্ড না। ব্যাংকের মুনাফা থেকে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ফান্ড কীভাবে গেছে তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর মন্ত্রী ও সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর ফলে তারা টাকা কোথায় খরচ করেছে তা বের করা সম্ভব হয়নি।’
মোহাম্মদ আলী আরাফাত ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। তিনি কোথায় আছেন, সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তাই এ বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।