অবশেষে জিও-গ্রাফিক্যাল আইডেন্টিফিকেশন (জিআই) বা ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে কুমিল্লার রসমালাই। এবছর চারটি পণ্য জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অন্য তিন পণ্য হলো টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুষ্টিয়ার তিলের খাজা এবং বাংলাদেশ ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মুশফিকুর রহমান বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় জিআই স্বীকৃতি পাওয়া কুমিল্লার রসমালাইয়ের বিষয়টি প্রকাশ করেন। এসময় তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পঙ্কজ বড়ুয়াসহ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে জিআই সনদটি প্রদর্শন করেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, একটি পণ্য চেনা ও জানার জন্য জিআই স্বীকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কুমিল্লা জেলা প্রশাসন রসমালাইয়ের বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করেছে। এই পণ্যটির জিইয়ের পর সনদ প্রাপ্তির মধ্যদিয়ে স্বীকৃতি মিলেছে। কুমিল্লার রসমালাই জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদনকারী কর্তৃপক্ষ হচ্ছে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন। তাই আমরা মনে করি এই পণ্যের উৎপাদন যাতে নির্ভেজাল ও সঠিক উপায়ে মানসম্পন্ন হয় এবং যত্রতত্র না হয়। এ বিষয়ে আবেদনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে জেলা প্রশাসনের নজরদারি থাকবে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মুশফিকর রহমান বলেন, সম্প্রতি কুমিল্লার রসমালাই জিআই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মধ্যদিয়ে এটির বৈশ্বিক স্বীকৃতি মিলেছে। জিআই হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় প্রথমত এই পণ্যটি কুমিল্লার বলে চিহ্নিত হলো। দ্বিতীয়ত, এই স্বীকৃতির মাধ্যমে পণ্যটির বাণিজ্যিকীকরণের সুবিধা বাড়লো। এই রসমালাই এখন দেশের বাইরেও রপ্তানি করা যাবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে রসমালাই উৎপাদনে মানের উন্নতি হবে। কেননা জিআই স্বীকৃতি পণ্যের মান নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, কুমিল্লার ইতিহাস ঐতিহ্যের ভাণ্ডার অনেক প্রাচীন। রসমালাইয়ের পর আমরা কুমিল্লার খাদি, বিজয়পুরের মৃৎশিল্প নিয়ে জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদনের জন্য কাজ শুরু করবো। এছাড়াও কুমিল্লার বরুড়ার লতি, হোমনার শ্রীমদ্দির বাঁশি নিয়েও পরবর্তীতে এগিয়ে যাবো।
শতবর্ষেরও বেশি সময়ের ঐতিহ্য নিয়ে স্বাদের জায়গাটি ধরে রেখেছে কুমিল্লার রসমালাই। কুমিল্লায় রসমালাইয়ের আদি উদ্ভাবক ত্রিপুরা রাজ্যের ঘোষ সম্প্রদায়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ত্রিপুরা থেকে ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী এ অঞ্চলের লোকদের বাহারি রকমের মিষ্টি সরবরাহ করতেন। সে সময় রসগোল্লার সঙ্গে মালাইকারির প্রলেপ দেওয়া এক রকম মিষ্টির প্রচলনও ছিল। ১৯৩০ সালের দিকে এই রসগোল্লার আকার ছোট করে দুধের খিরের মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন শুরু হয় এবং একপর্যায়ে এর নামকরণ হয় রসমালাই। আর ওই সময় থেকেই ক্ষণীন্দ্র সেন কুমিল্লার মিষ্টি ব্যবসায় রসমালাই বানিয়ে পরিচিতি পেতে থাকেন।
পরবর্তীতে মাতৃভাণ্ডার নামের প্রতিষ্ঠানে ক্ষণীন্দ্র সেনের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা শংকর সেনগুপ্তের হাত ধরে কুমিল্লার রসমালাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। বর্তমানে মাতৃভান্ডারের ব্যবসা পরিচালনা করছেন প্রয়াত শংকর সেনগুপ্তের ছেলে অনির্বাণ সেনগুপ্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী কোনো চাকরিতে না গিয়ে বংশপরম্পরায় পরিবারের মিষ্টান্ন ব্যবসায় শামিল হন।
কুমিল্লার রসমালাইয়ের জিআই স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে অনির্বাণ সেনগুপ্ত কুমিল্লা জেলা প্রশাসনসহ শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, কুমিল্লার রসমালাই একদিকে যেমন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি সুস্বাদু মিষ্টি হিসেবে বিদেশিদের কাছেও বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করেছে। আর জিআই সনদের স্বীকৃতি এই পণ্যটির প্রসার আরও বাড়াবে।