সমতট ডেস্ক: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় আরও কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই কঠোর অবস্থানের কথা জানান। টকশোতে নিয়মিত অংশগ্রহণকারী বিএনপি এবং পেশাজীবী নেতাদের নিয়ে দলের মিডিয়া সেলের আয়োজনে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
জানা গেছে, গত ১৩ জুনের ‘লন্ডন বৈঠকের’ পর নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিএনপির ঐকমত্য হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তারেক রহমান দলীয় এই অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এর প্রতিফলন হিসেবে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় হাইকমান্ডের নির্দেশে দলের দুই নেতাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে বিএনপি। দলটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষায় যেন কোনো চিড় না ধরে, তা রক্ষা করতে এমন কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখতে চায়।
দলের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত দল ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের তিন সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থার মধ্যে বহিষ্কারের পাশাপাশি পদ স্থগিত এবং পদাবনমনও রয়েছে। এছাড়াও, কয়েকজনের বিরুদ্ধে দলের পক্ষ থেকে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন বক্তব্যে বিতর্কের সৃষ্টি করায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু এবং শামসুজ্জামান দুদুকে লিখিতভাবে সতর্ক করা হয়েছে।
কর্মশালায় ড. ইউনূসের সঙ্গে লন্ডন বৈঠকের পাশাপাশি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, বিভিন্ন সংকট এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। উপস্থিত কয়েকজন নেতা জানান, তারেক রহমান কর্মশালায় উল্লেখ করেন যে বিএনপি আগামীতে সরকার গঠন করলে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার হবে। একই সাথে তাদের আমলে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, ভোট ডাকাতি এবং গুম-খুনের প্রতিটি ঘটনার বিচার করা হবে।
বিএনপি সামনের নির্বাচনে সরকার গঠনের ব্যাপারে আশাবাদী এবং এর জন্য তারা আর একটি দিনও নষ্ট করতে চায় না। এরই মধ্যে দলটি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১৮০ দিনের অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই কর্মপরিকল্পনায় প্রথম ১৮ মাসে এক কোটি কর্মসংস্থান বা চাকরির ব্যবস্থা করার এবং ২০৩৪ সালে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা এক ট্রিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। জানা গেছে, তারেক রহমান এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের অভিমত, বর্তমানে দেশের অর্থনীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। অর্থনীতির ভান্ডার প্রায় শূন্য, সব সূচক নিম্নমুখী, দারিদ্র্য বাড়ছে, মানুষের আয় কমে গেছে, বিনিয়োগ নেই এবং অনেক মিল-কারখানা ও গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, গত এক বছরে এক লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক বেকার হয়েছেন। এই চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, তা নিয়েও আলোচনা হয়।
জানা গেছে, কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা লন্ডন বৈঠকের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরলেও যারা এটি চায়নি, তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিলে তারেক রহমান এ বিষয়ে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি দলীয় নেতাদের উদ্দেশে বলেন, “দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কোনো বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করা যাবে না।” তিনি আরও বলেন, “যত বড় ত্যাগী নেতা হন, যত মামলা থাকুক কিংবা যতই জেল-জুলুমের শিকার হন—অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের আইনের হাতে তুলে দিতে হবে।”
কর্মশালায় নরসিংদীর পলাশ এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ঘটনা উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, এই ঘটনায় তিনি অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছেন, ব্যথিত হয়েছেন এবং একই সাথে ক্ষুব্ধও। ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কালিয়াকৈরে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এমন ঘটনা কোথাও আর বরদাস্ত করা যাবে না। বিএনপির প্রতি জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা-প্রত্যাশা, সেটা কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না।”
উল্লেখ্য, গত রোববার নরসিংদীর পলাশে শোডাউনকে কেন্দ্র করে জেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল কবির জুয়েলের সমর্থক এবং ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে এক ছাত্রদলকর্মী গুলিবিদ্ধসহ উভয়পক্ষের তিনজন আহত হন। একই দিনে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে উপজেলা বিএনপির নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া এবং ককটেল বিস্ফোরণে উভয়পক্ষের কমপক্ষে ১০ জন আহত হন। ঘটনাটি উপজেলার সাহেব বাজার এলাকায় ঘটে।
তারেক রহমান আরও বলেন, “দুই-চারজন অপকর্মকারীর জন্য বিএনপির সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এর দায়-দায়িত্ব কেন আমরা নেব? আমরা রাজনীতি করি জনগণের কল্যাণের জন্য, আমরা নেতাকর্মীদের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেই। আমরা আওয়ামী লীগের মতো মাস্তানি-গুন্ডামি করার শিক্ষা দেই না।”
তিনি নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বলেন, “অনেকে মনে করছে আওয়ামী লীগ তো নেই। সামনে নির্বাচন হলে বিএনপিই তো ক্ষমতায় আসবে। আমি বলব, ভোটকে ভোট হিসেবেই নিতে হবে। আগামীর নির্বাচন মোটেই সহজ হবে না। মানুষের মন জয় করেই তাদের ভোট নিতে হবে। আপনারা (কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা) সব জায়গায় এ বার্তা পৌঁছে দিন।”
কর্মশালা প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, এতে দেশের বর্তমান-ভবিষ্যতের বিভিন্ন বিষয়, চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই কর্মশালায় সংযুক্ত ছিলেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেন, “লিখিতভাবে আমরা আমাদের মতামত তুলে ধরি। তারেক রহমান নির্বাচনের পরিবেশ সুন্দর ও নির্বিঘ্ন করার জন্য সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার জন্যও বলেছেন।”
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. সুকোমল বড়ুয়া, যুগ্ম মহাসচিব ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য রুমিন ফারহানা, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নি, কেন্দ্রীয় নেতা নিলুফার চৌধুরী মনি, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুল, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ এবং সিনিয়র সাংবাদিক এমএ আজিজ প্রমুখ।