সমতট ডেস্ক: ইসরাইলের সাম্প্রতিক হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন সামরিক কমান্ডার নিহত হওয়ার পর, দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি নতুন সামরিক নেতৃত্ব ঘোষণা করেছেন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার হোসেইন সালামি, খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার গোলামালি রশিদ এবং আইআরজিসির এরোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহ।
বিবিসি জানিয়েছে, ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর গত শুক্রবার সকালে এটি ছিল ইরানের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক বিদেশি আক্রমণ। এই আক্রমণের পরই সর্বোচ্চ নেতা খামেনি এক বার্তায় বলেন, নিহত কমান্ডারদের ‘উত্তরসূরি এবং সহকর্মীরা অবিলম্বে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন’। এরপর তিনি তিনটি নিয়োগ ডিক্রি জারি করেন, যেখানে পূর্ববর্তী কমান্ডারদের স্থলাভিষিক্ত করে তিন জেনারেলকে নিয়োগ দেন।
ইরানের নতুন সামরিক কমান্ডারগণ:
১. আব্দুর রহিম মুসাভি, সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ প্রধান: মেজর জেনারেল সাইয়্যেদ আবদুর রহিম মুসাভি, যিনি ১৯৫৯ সালে ইরানের কোমে জন্মগ্রহণ করেন, তাকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছে। এটি ইরানের সামরিক কমান্ডের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, কারণ প্রথমবারের মতো আইআরজিসি কমান্ডারদের বাইরের কাউকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি ইরানের সামরিক কাঠামোতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা পুনঃর্নিধারণের ইঙ্গিত হতে পারে। আবদুর রহিম মুসাভি একজন অভিজ্ঞ সামরিক ব্যক্তিত্ব এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধের একজন ‘যুদ্ধে অভিজ্ঞ’ সৈনিক হিসেবে পরিচিত। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২. মোহাম্মদ পাকপুর, বিপ্লবী গার্ডের কমান্ডার: ১৯৬১ সালে আরাক শহরে জন্মগ্রহণকারী মেজর জেনারেল মোহাম্মদ পাকপুরকে ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)-এর কমান্ডার-ইন-চিফ নিযুক্ত করা হয়েছে। এই নিয়োগের আগে তিনি ১৬ বছর ধরে আইআরজিসির স্থল বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। পাকপুর ইরানের প্রাথমিক বিপ্লবের নিরাপত্তা সংকটে এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ক্লাসিক্যাল এবং গেরিলা যুদ্ধে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কমান্ডারদের একজন। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আইআরজিসির ভূমিকার ওপর তিনি সবসময় জোর দিয়েছেন।
৩. আলী শাদমানি, খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার: ইসরাইলি আক্রমণে গোলামালি রশিদ নিহত হওয়ার পর হামেদান শহরে জন্মগ্রহণকারী আলী শাদমানিকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। এটি ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর সবচেয়ে বড় ও কর্মক্ষম ঘাঁটি, যা যুদ্ধ এবং সংকটময় পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী, আইআরজিসি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধনে কাজ করে। আলী শাদমানি ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর আইআরজিসিতে যোগ দেন এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৪. আমির হাতামি, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক: শুক্রবার গভীর রাতে আরেকটি ডিক্রি জারি করা হয়, যেখানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামিকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয় এবং আবদুর রহিম মুসাভির স্থলাভিষিক্ত করে ইসলামিক রিপাবলিক আর্মির কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬৬ সালে জানজানে জন্মগ্রহণকারী আমির হাতামি ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হাসান রুহানির দ্বিতীয় মেয়াদের প্রশাসনে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ইরান-ইরাক যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সামরিক বাহিনীতে গোয়েন্দা ও অপারেশনাল ক্ষেত্রগুলিতে তার পদোন্নতি অব্যাহত ছিল। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল কার্যকলাপের দায়ে তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
৫. হোসেইন (মাজিদ) মুসাভি ইফতেখারি, আইআরজিসি এরোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার: ১৪ জুন, আলী খামেনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাজিদ মুসাভিকে আইআরজিসির এরোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন। মাজিদ মুসাভি নামে পরিচিত হোসেইন মুসাভি ইফতেখারি তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি বিপ্লবী গার্ডের একজন অভিজ্ঞ কমান্ডার। এই নিয়োগের আগে, তিনি আইআরজিসি এরোস্পেস ফোর্সের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন সিস্টেম এবং মহাকাশ সরঞ্জামের নকশা, উন্নয়ন এবং বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
এই নতুন নিয়োগগুলো ইরানের সামরিক কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে এবং এটি ইসরাইলের হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।