সমতট ডেক্স : আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতি-অনিয়মের বড় বড় ঘটনার মধ্যে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ বাণিজ্যের খবরও দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। কর্মচারী থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তারও এই কাজে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছিল। বিশেষ করে সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ টি এম শামসুজ্জামানের গ্রেফতারের পর জড়িতদের মুখোশ উম্মোচন হয়। পতিত সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্কের জোরে জড়িতরা বহাল তবিয়তে থেকে এখন ভোল পাল্টে বাগিয়ে নিচ্ছেন বড় বড় পদ। আবার আওয়ামী লীগের সময়ের প্রভাবশালী পরিচালক জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় বাগিয়ে নিয়েছেন চেয়ারম্যানের পদ। অন্যদিকে সনদ জালিয়াতির মতো গুরুতর ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও বহাল তবিয়তে আছেন আওয়ামী ঘরানোর কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহ।
বোর্ডের কর্মকর্তারা যখন নিজেদের মতো করে সব বাগিয়ে নিচ্ছেন তখন পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতি ও বাংলাদেশ পলিকেটনিক শিক্ষক পরিষদের নেতারাও। সব কিছুই চলে তাদের ইশারায়। আওয়ামী লীগ আমলে দাপট দেখিয়ে এদের শীর্ষ নেতারা প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টিং নিয়ে আছেন।
গত বছরের ২২ নভেম্বর বোর্ডের মডেল নিয়োগবিধি প্রণয়ন কমিটিতেও এই দুই সংগঠনের দুজন করে সদস্য পদ বাগিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছে, বোর্ডের কর্মকর্তা এবং শিক্ষক নেতারা এতদিন দাপট দেখাতেন আওয়ামী ঘরোনার লোক হিসেবে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর ভোল পাল্টে অনেকেই এখন নিজেদের বিএনপি-জামায়াতের লোক বলে পরিচয় দিচ্ছেন।
১৯৬৭ সালে স্থাপিত কারিগরি শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মান প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষা নেওয়া ও সনদ প্রদান, নতুন প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া, মূল্যায়ন ও উন্নয়নের সার্বিক দায়িত্ব পালন করে থাকে।
বোর্ডের আওতায় বর্তমানে সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, বেসরকারি, এনজিও ও ব্যক্তি উদ্যোগে ১০ হাজার ৫০০টি বিভিন্ন ধরণের কারিকুলাম পরিচালিত হয়।
বোর্ডের আওতায় পরিচালিত ২৯টি কারিকুলামের কোর্স প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, প্রতিষ্ঠান স্থাপন, পরীক্ষা গ্রহণসহ যাবতীয় একাডেমিক কাজ পরিচালনা করে। কিন্তু এসব কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিক্ষক সমিতি ও পরিষদের নেতাদের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষক সংগঠনের নেতাদের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের আস্থাভাজন ছিলেন বলে জানা গেছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সংগঠনের নেতারা বলছেন, বোর্ডের কোনো কার্যক্রমে তাদের কোনো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জি এম আকতার হোসেন বলেন, ‘এগুলো স্রেফ ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ। আমরা বোর্ডের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করি না।’
বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক পরিষদের সভাপতি মো. খালেদ হোসেন নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি দশ বছর ধরে ঢাকা পলিটেকনিকে আছি। এ কারণে আমাকে আওয়ামী লীগের দোসর বলা হয়। কিন্তু ১৫ বছর ধরেও তো অনেকে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে তো কেউ কোনো কথা বলছে না।’ যদিও শিক্ষকদের এই পদগুলো বদলিযোগ্য।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এখানকার বর্তমান চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রকিব উল্লাহ জুলাই অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এক প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের সুপারিশে ২০২৩ সালের ১২ মার্চ জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বোর্ডের পরিচালক (কারিকুলাম) পদে বসেন তিনি।
অভিযোগ আছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি মহলকে ‘ম্যানেজ’ করে চেয়ারম্যান পদ পেয়েছেন রকিব উল্লাহ। যে কারণে একযোগে একাধিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নতুন মুখ এলেও বহাল আছেন রকিব উল্লাহ।
অন্যদিকে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহ আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একই এলাকার লোক। যে কারণে তার প্রভাবেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন কেপায়েত উল্লাহ। তার শাখায় সনদ জালিয়াতির মতো ঘটনা ঘটলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখনো আছেন বহাল তবিয়তে।
এ বিষয়ে কেপায়েত উল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার তার মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
পলিটেকনিক শিক্ষকদের পাঠদান বিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই ক্লাস পরিচালনা করার ফলে ডিপ্লোমা কোর্সের শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। কিন্তু সেই শিক্ষকদেরই অনেকে প্রেষণে বোর্ডে এসে কারিকুলাম ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্টের কাজ করছেন।
অভিযোগ আছে, ঢাকায় থাকার পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে পলিটেকনিকের শিক্ষকরা বোর্ডে পদায়ন নেন। যেখানে শিক্ষক সমিতির নেতারা বেশি প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। যদিও বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। কিন্তু শিক্ষকরা প্রেষণে এসে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসায় বোর্ডের কর্মকর্তারা হয়ে পড়ছেন কোনঠাসা।
জানা গেছে, পলিটেকনিকে বর্তমানে প্রায় ৮৫ ভাগ পদে শিক্ষক নেই। অন্যদিকে শিক্ষক সংগঠনগুলো ভেঙে পড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের কথা বাদ দিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর ও বোর্ড থেকে তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানে শিক্ষক সংকট থাকার পরও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অনেককে অধিদফতর ও বোর্ডে পদায়ন করতে কাজ করছেন নেতারা।
মানবেতর জীবন যাপন করছেন স্টেপের শিক্ষকরা
এদিকে স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট- (স্টেপ) এর আওতায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে বেতন ভাতা পাচ্ছেন না বলে তথ্য পাওয়া গেছে। যে কারণে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাদের। অথচ এদিকে নজর নেই শিক্ষক সমিতির নেতাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান চেয়ারম্যান, সচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ‘অদক্ষতার’ কারণে সময়মতো পরীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উত্তরপত্র প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হয়। প্রয়োজনীয় উত্তরপত্র না থাকায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা দুইবার পিছিয়ে ডিসেম্বর মাসের এক তারিখ থেকে শুরু করা হয়। এসএসসি (ভোকেশনাল) নবম শ্রেণির পরীক্ষা নভেম্বর মাস থেকে পিছিয়ে ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ হইতে শুরু করা হয়। তাদের অদক্ষতার কারণে সময়মতো উত্তরপত্র প্রস্তুত করতে না পারায় এই ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়াও দেশে বড় বড় আইটি ফার্ম ও আইটি প্রফেশনাল থাকা সত্ত্বেও বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে প্রেরণের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যারটি ভারতের একটি সফটওয়্যার কোম্পানি ‘কনসাল্টিং অটোমেটিক বিডি লিমিটেড’ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যা ভারতে অবস্থিত সার্ভারের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
সনদ জালিয়াতিতে জড়িতরা বহাল তবিয়তে
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সার্টিফিকেট জালিয়াতির সঙ্গে যাদের নাম জড়িত তারা বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সংঘবদ্ধ এসব ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে এবং অর্থের বিনিময়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গত বছর পুলিশের হাতে আটক কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী একেএম শামসুজ্জামান রিমান্ডে সনদ জালিয়াতির সঙ্গে বোর্ডের এই লোকজন জড়িত বলে জানিয়েছেন। যদিও আলোচিত এই শামসুজ্জামান ইতোমধ্যে জামিনও পেয়েছেন।
জানা যায়, সনদ জালিয়াতির সেই ঘটনায় দায়ের করা মামলার এজাহারে যাদের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে সিস্টেম অ্যানালিস্ট মো. শামসুল আলম, উপ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ইঞ্জিনিয়ার জাকারি আব্বাসী এবং কম্পিউটার অপারেটর আব্দুল বাসেত বোর্ডে তাদের অবস্থান শক্তও করছেন। বোর্ডের এই কাজের সঙ্গে যাদের নাম রয়েছে বর্তমান প্রশাসন এদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বহাল তবিয়তে কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ করে দিচ্ছে। অন্যদিকে, প্রধান অভিযুক্ত জামিনে থাকায় এই চক্রের সাহস আরও বেড়েছে।
জানা গেছে, সনদ জালিয়াতির সেই ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় বোর্ড কোনো ধরণের যোগাযোগও করছে না।উল্টো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে, জাকারিয়া আব্বাসী পরীক্ষা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকায় সিবিএর সভাপতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়ার কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন। সিবিএর সভাপতি অনেক বছর ধরে সনদ শাখায় কাজ করার সুবাদে একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এর আগে, জাকারিয়া আব্বাসী রেজিস্ট্রেশন শাখায় কর্মরত থাকা অবস্থায় রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতির মতো কর্মকাণ্ডেও তার নাম এসেছিল। দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক লোকের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতি করার অভিযোগে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।