সমতট ডেক্স: বাংলাদেশ গত দেড় দশকে পরিণত হয় ভারতের পণ্যবাজারে। হাসিনা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারত বাংলাদেশের বাজার দখল করে নেয়। ভারতের মানহীন ভেজাল পণ্যের সহজ আমদানির যত দরজা ছিল, সবই খুলে দেওয়া হয়। পণ্য আমদানি সহজ করতে বাংলাদেশের শুল্ক স্টেশনগুলো রূপ নেয় স্থলবন্দরে। অন্যদিকে ভারতের আরোপিত শুল্ক-অশুল্ক বাধায় বাংলাদেশি পণ্য ভারতের বাজারে ঢুকতে পারেনি। এতে ভারেতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি পাহাড় সমান হয়ে পড়ে।
বাণিজ্য ঘাটতি বিষয়ে রফতানিকারকরা বলছেন, মূলত ট্যারিফ-ননট্যারিফ বাধার কারণেই ভারতের বাজারে পণ্য রফতানি আশানুরূপ হারে বাড়েনি। তবে আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কোনো বাধা নেই। ফলে পণ্য আমদানি বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ আমার দেশকে বলেন, ‘ভারত যতই ডিউটি ফ্রি বলুক আর বাজার সুবিধার কথা বলুক, ওরা সব সময়ই তাদের দেশে পণ্য প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাদের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের আইন প্রয়োগ করে পণ্য আমদানি ঠেকিয়ে দেয়। আর এতে পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ কাজ করে।’
পারভেজকে প্রশ্ন করা হয়- তবে আমাদের মধ্যে কি দেশাত্মবোধ নেই? তিনি বলেন, কোথায় আছে বিগত দেড় দশক তো আমরা দেখলাম। এতদিন তো কেউ আমাদের রফতানি বাজারের বাধার বিষয়গুলো জানতে চায়নি। উল্টো আমাদের সুযোগ-সুবিধাও সংকুচিত করা হয়েছে।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মোট আমদানির প্রায় ১৪ শতাংশই আনা হয় ভারত থেকে। ডলার হিসাবে যা ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন প্রায়। বাংলাদেশি টাকার অঙ্কে ৯৯০ বিলিয়ন ডলার প্রায়। ভারতের হিসাবে গত অর্থবছরে তাদের কাছ থেকে যেসব দেশ পণ্য কিনেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ হলো শীর্ষ ৪-এ, যা মাত্র দুবছর আগেও ৯-এর ঘরে ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রফতানি হয় মাত্র এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২২ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে ভারতের সঙ্গেই ঘাটতি সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি।
ভারত থেকে এত বিপুল অঙ্ক ব্যয়ে পণ্য আনা হলেও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা বা মালদ্বীপ এর ধারেকাছেও নেই। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাকিস্তান বাংলাদেশের আমদানি তালিকার ২০ নম্বরে ছিল। এ সময়ে পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়েছে ৬২৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। আমদানিকারকরা বলছেন, ভারতকে একতরফা সুবিধা দেওয়ায় তারা বাংলাদেশে সব ধরনের পণ্য রফতানির সুযোগ পাচ্ছে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৪.৪ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ও প্রক্রিয়াজাত চামড়া। এছাড়া সিমেন্ট ক্লিংকার, ফলমূল ও থ্রিপিস পোশাক আমদানি করা হয়। এ সময় বাংলাদেশ পাকিস্তানে ৬২.৬ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। রফতানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন, চা ও তৈরি পোশাক।
গত এক দশকে বাংলাদেশ তিনগুণ আমদানি বাড়িয়েছে ভারত থেকে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশটি থেকে মাত্র ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল। এর পরের ১৫ বছরে আমদানি বেড়েই চলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশভিত্তিক বাণিজ্য ঘাটতির হিসাব প্রকাশ করেনি। তবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি সাত দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
এক সময়ে ভারত থেকে শুধু বস্ত্র খাতের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় তুলা আমদানি হতো। তবে সেই চিত্র আর নেই। এখন ভারত থেকে পাথর, কয়লা, রাসায়নিক সার, চায়না ক্লে, টিম্বার, চুনাপাথর, পেঁয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন, মসুর ডাল, তাজা ফুল, গমের ভুসি, চালের কুঁড়া, শুঁটকি মাছ, হলুদ, জীবন্ত মাছ, হিমায়িত মাছ, পান, মেথি, চিনি, গাড়ির যন্ত্রাংশ, রেডিও-টিভির পার্টস, মার্বেল স্লাব, শুকনো তেঁতুল, ফিটকারি, অ্যালুমিনিয়াম, কিচেনওয়্যার, ফিশ ফিড, আগরবাতি, জুতার সোলসহ হাজারো পণ্য আসে।
আমদানির খরচ হিসাব করে সবচেয়ে অবাক করা তথ্য পাওয়া গেছে আলুর ক্ষেত্রে। মাত্র কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আলু রফতানিতে শীর্ষ দেশের তালিকায় ছিল। তবে কৃষি খাত ধ্বংসকারী হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে (২০২৩-২৪ অর্থবছরে) ভারত থেকে আলু এসেছে ১৭ লাখ মার্কিন ডলারের। এর আগে দেশে আলু আমদানিই হয়নি। ওই অর্থবছরে কৃষি অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, গত বছর বাংলাদেশে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক কোটি ১৬ লাখ টন। তবে তাদের তথ্য বলছে, উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ছয় লাখ টন।
চালে ভারতনির্ভরতা
ভারত থেকে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করা হয়। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে দেড় কোটি ডলারের চাল রফতানি করে ভারত, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৩১ কোটি ডলার। চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্যে পুরোপুরি ভারতনির্ভরতার একটি বৃহৎ পরিকল্পনা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবেই। আর এতে চালের বাজার এখন ভারতনির্ভর। জাতিসংঘের বাণিজ্যবিষয়ক ডেটাবেজ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে আট কোটি ডলারের চাল রফতানি করে ভারত।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে মোট পণ্য বাণিজ্য হয়েছে এক হাজার ২৯১ কোটি ডলারের। এর মধ্যে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানির অর্থমূল্য ছিল এক হাজার ১০৬ কোটি ডলার। আর রফতানি হয়েছে ১৮৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের পণ্য।
ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য বিভাগের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে দেশটি বাংলাদেশে মোট পণ্য রফতানি করে দুই হাজার ৩১৬ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এ বছর তারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে ২৩৫ দশমিক ৯১ মিলিয়ন ডলারের।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশের বাজারে পণ্য রফতানি করে ৩৩৮৫ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলারের। এ বছর বাংলাদেশ থেকে তারা পণ্য নেয় ৫৮৩ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলারের।
২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশের বাজারে পণ্য রফতানির একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে ভারত। ২০১৭ সালে ৮১৩৬ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে দেশটি। আর এ বছর বাংলাদেশ থেকে রফতানি হয় মাত্র ৬০৪ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে পণ্য বাজার আরও বিস্তৃত করে ভারত। এ বছর বাংলাদেশের বাজারে ভারতের রফতানি ছিল ৯ হাজার ৪৩৯ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলারের। কিন্তু এ সময় বাংলাদেশ ভারতের বাজারে রফতানির সুযোগ পায় মাত্র ৯৩৫ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলারের।
বছরভিত্তিক হিসাবে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের বাজারে ভারতের রফতানির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ২৫৫ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলারের। গত বছর বাংলাদেশ ভারতের বাজারে রফতানি করেছিল মাত্র ১৯০৭ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ডলারের।
বাংলাদেশের মোট আমদানি-রফতানি পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত অর্থবছর পর্যন্ত বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২২.৪৩ বিলিয়ন ডলারের, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৭.৩৮ বিলিয়ন ডলারের।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে ৪৬৬.৩৩ মিলিয়ন ডলারের, মিয়ানমারের সঙ্গে ১১৬.২১ মিলিয়ন ডলারের, ভুটানের সঙ্গে ১৪.২৯ মিলিয়ন ডলারের এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে ১.৪৯ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। তবে নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো বাণিজ্য ঘাটতি নেই।