সমতট ডেস্ক।। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ধীরে ধীরে বাড়ছে ‘জাতীয়তাবাদী’ বা ‘জিয়া’ নামের সংগঠনের সংখ্যা। ক্ষমতার স্বাদ পেতে নামসর্বস্ব সংগঠন করেই অনেকেই বনে যাচ্ছেন নেতা। নামের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ও জিয়া পরিবারের নাম ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে এসব ‘ভুঁইফোড়’ সংগঠন। এতে দুশ্চিন্তায় বিএনপির হাইকমান্ড। প্রায় আড়াই মাস আগে জাতীয়তাবাদী বা বিএনপি নামে কোনো সংগঠন করতে দলীয়ভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী রিকশা-ভ্যান-অটোচালক’ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আবার কয়েক বছর চুপচাপ থাকা সংগঠনগুলো নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠছে।
দলীয় সূত্রমতে, বিএনপির নাম ব্যবহার করে নামসর্বস্ব ভুঁইফোড় সংগঠন আগেও ছিল। মাথাব্যথার কোনো কারণও ছিল না। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এখন সুবিধাবাদীরা সংগঠনের নামের আগে জাতীয়তাবাদী বা বিএনপির নাম জুড়ে দিচ্ছেন। সংগঠনের কর্ণধার সুযোগ বুঝে বিএনপিতে যোগ দিচ্ছেন। সভা-সমাবেশের নামে অর্থ আয় করা ও ক্ষমতায় গেলে দলীয় নেতাদের কাছে লাভবান হওয়ার চিন্তা থেকেই সংগঠনগুলো গড়ে উঠছে। এর পেছনে বিএনপির কিছু কেন্দ্রীয় নেতারও ভূমিকা রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খবরের কাগজকে বলেন, ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ব্যানারে কোনো নেতা কোথাও দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেননি। সেই সময়ে এসব ছোট ছোট সংগঠনের ব্যানারে অনেকে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। বর্তমানে দেখতে হবে যেনতেন কোনো ব্যক্তি যেন জাতীয়তাবাদী নামে সংগঠন করতে না পারেন। আমি মনে করি, এসব সংগঠনের নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি, কোনো উদ্দেশে আসছে, কেন আসতে চাইছে- এ ব্যাপারে নিজেদের সতর্ক থাকতে হবে। দলের নেতারা তাদের গুরুত্ব না দিলে তারা সুবিধা নিতে পারবেন না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নানা রকমের ঘটনা ঘটছে। বিএনপিতে প্রতিনিয়ত লোকজন আসছে। জাতীয়তাবাদী নাম ব্যবহারে কিছুটা বিশৃঙ্খলা বা উচ্ছৃঙ্খলা হয়তো চলছে। দলের পক্ষ থেকেও সংগঠন গঠনের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। তবে এসব সংগঠনের প্রোগ্রামে যারা যাচ্ছেন তাদেরও সতর্ক থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।’
বিএনপির একাধিক নেতা অভিযোগ করেন, ৫ আগস্টের পর নতুন নামে সুবিধাবাদী সংগঠনগুলো আত্মপ্রকাশ করছে। তাদের তৎপরতাও বেড়েছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান অথবা নামের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী নামজুড়ে দিয়ে সংগঠন করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। রাজনৈতিক পটপরির্বতনের পর অদ্ভুত সব নাম ব্যবহার করে প্রোগ্রাম ও কর্মসূচির কথা বলে অনেকেই নেমে পড়েছেন চাঁদা তোলায়। যদিও তাদের নেই দলীয় স্বীকৃতি।
জানা গেছে, সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী রিকশা-ভ্যান-অটোচালক’, ‘বাংলাদেশ নাগরিক অধিকার আন্দোলন’ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরা বিভিন্ন বিষয়ে মানববন্ধন, সমাবেশ ও সেমিনারের আয়োজন করছে। এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টারা অংশ নেন। বিএনপির সমর্থক সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠা প্যাডসর্বস্ব ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর তৎপরতা মূলত ছিল জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে ও সামনের সড়কে এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিকেন্দ্রিক। কিন্তু ৫ আগস্টের পর এখন নয়াপল্টনে পার্টির অফিসের সামনেও কর্মসূচি পালন করছে তারা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী খবরের কাগজকে বলেন, এসব সংগঠনের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা দলের কেউ নন। যদি এসব সংগঠনের সঙ্গে দলের কেউ জড়িত থাকেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যেসব নেতা এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে দল সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে।
বিএনপির স্বীকৃত অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বাইরে শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাব, ডাক্তারদের সংগঠন ড্যাব, ইঞ্জিনিয়ার ও কৃষিবিদদের সংগঠন এ্যাব, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, নব্বইয়ের ডাকসু সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য রয়েছে। গত ২৪ অক্টোবর নয়াপল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ কোনো সংগঠন করলে এর সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। জিয়া পরিবার ও জাতীয়তাবাদী নামে কোনো সংগঠন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাতীয়তাবাদী লাগিয়ে নামকরণ করা সংগঠনগুলো হলো প্রচার দল, রিকশা ভ্যান-অটোচালক দল, চালক দল, তরুণ দল, গণতন্ত্র পরিষদ, বাউল দল, প্রজন্ম দল, নাগরিক ফোরাম, নাগরিক দল, মানবাধিকার ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, সেবাদল, বাস্তুহারা দল, সাংস্কৃতিক দল, কর্মজীবী কল্যাণ পরিষদ, তৃণমূল দল, বন্ধুদল, নতুন বাংলাদেশ, ঢাকা ওয়াসা জাতীয়তাবাদী এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী নাগরিক আন্দোলন।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নামে নামকরণ করা সংগঠনগুলো হলো ‘জিয়া নাগরিক ফোরাম, জিয়া আদর্শ একাডেমি, জিয়া সেনা, জিয়া স্মৃতি সংসদ, জিয়া ব্রিগেড, জিয়া ন্যাশনালিস্ট ফোরাম, শহিদ জিয়াউর রহমান আদর্শ বাস্তবায়ন পরিষদ, শহিদ জিয়ার ১৯ দফা বাস্তবায়ন পরিষদ। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নামে আছে দেশনেত্রী পরিষদ, খালেদা জিয়া পরিষদ, তারেক জিয়া ফোরাম, তারেক পরিষদ, তারেক রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংগ্রাম পরিষদ।
বিএনপির নাম ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক একাডেমি, সম্মিলিত সমন্বয় পরিষদ, সচেতন নাগরিক ফোরাম, গণতান্ত্রিক ঐক্য ফোরাম, চেতনায় ৭১, দেশপ্রেমিক মঞ্চ, স্বদেশ জাগরণ ফোরাম, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন, হৃদয়ে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইয়ুথ ফোরাম, স্বাধীনতা অধিকার ফোরাম, সুশীল ফোরাম, জাতীয় নাগরিক ফোরাম, বাংলাদেশ নাগরিক অধিকার, বাংলাদেশ নবীন দল।
এদিকে জাতীয়তাবাদী প্রচার দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগও রয়েছে। তার মধ্যে সভাপতি মাহফুজ কবির মুক্তা চাকরি দেওয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি দেননি। ফলে বছর তিনেক আগে চেক ডিজঅনার মামলায় কয়েক মাস জেলও খেটেছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতাদের কাছে প্রচার করেন যে, তিনি ‘শেখ হাসিনার আমলে সাইবার সিকিউরিটি আইনের মামলায় জেল খেটেছেন’। বর্তমানে বিএনপির সভা-সমাবেশে তার ব্যবহারের কারণে মূল ধারার গণমাধ্যম কর্মীরাও ক্ষুব্ধ।
জাতীয়তাবাদী প্রচার দলকে বিএনপির সহযোগী সংগঠন দাবি করে প্রচার দলের আহ্বায়ক মাহফুজ কবির মুক্তা বলেন, তিনি মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর এলাকায় ছাত্রদলের মিছিলে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ফেসবুকে লাইভ দেওয়ার সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। এরপর তাকে পুরোনো চেক ডিজঅনার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি বলেন, মূলত একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের তিনটি মামলা ছিল। তিনি প্রতিষ্ঠানটির একজন অংশীদার হওয়ায় ওই মামলায় জেল খেটেছেন। মুক্তার দাবি, ২৪ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি রয়েছে তাদের। তারাই ‘বিএনপির প্রচার কার্যকক্রম’ চালান। এটি আসলে বিএনপির একটি সেল। বিএনপির ফেসবুক পেজসহ সবকিছুই তাদের হাত দিয়ে শুরু হয়েছে। এরপর বিএনপির অফিশিয়াল পেজ চালু করেছেন।
তবে এ বিষয়ে বিএনপির মিডিয়া সেলের একাধিক সদস্য জানান, জাতীয়তাবাদী প্রচার দলের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। প্রচার দলের কেউ বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা বললে তাকে ধরিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করার কথা বলেন তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তাদের এ রকম শতাধিক সংগঠন ছিল। তাদের দখল ও চাঁদাবাজির কারণে জনগণ অতিষ্ঠ ছিল। তাই বিএনপি এখনই সতর্ক না হলে তাদেরও আওয়ামী লীগের মতো জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। তাই এসব সংগঠনের প্রোগ্রামে কারা কারা আসছেন, সংগঠন গড়ে ওঠার পেছনে কাদের ইন্ধন রয়েছে ও কারা চাঁদাবাজির সুযোগ করে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, বিএনপি অলরেডি বলে দিয়েছে, অজনপ্রিয় কাজ ও কোনো ধরনের অপর্কমের দায় তারা নেবে না। তিনি বলেন, যারা জাতীয়তাবাদী ট্যাগ দিয়ে সংগঠন গঠন করছে তারা ধরেই নিয়েছে বিএনপি আগামী দিনে ক্ষমতায় আসবে। তাই বিএনপির নাম ব্যবহার করে তারা সাকসেসফুল হতে চাইছে। এটা তাদের একটি পলিটিকস।