গোলাম মাওলা রনি : ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারের নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনকে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আখ্যা দিয়ে সরকার মূলত ত্রিমাত্রিক উপায়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কাজের কাজ কতটুকু হয়েছে তা এ মুহূর্তে আন্দাজ করা না গেলেও সরকারি এ সিদ্ধান্তে বহুমাত্রিক বিতর্ক ও সমস্যা দেখা দিয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যমে না এলেও সামাজিক মাধ্যমে এমন সব ঘটনা ছবি এবং কাহিনি প্রচারিত হচ্ছে, যা আগামীতে এমন সব কলঙ্কিত অধ্যায় তৈরি করবে যার সঙ্গে অতীতের কোনো কিছুর তুলনা হবে না।
আমরা একসময় জঙ্গি নাটক নিয়ে অনেক ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটতে দেখেছি। বিভিন্ন নিষিদ্ধ এবং বৈধ সংগঠনের নেতা-কর্মীকে জিহাদি বইপত্র নিয়ে গ্রেপ্তার হতে দেখেছি। অতীতের সেসব ঘটনা গরু হয়ে মধুর ক্যান্টিনে প্রবেশ করবে কিংবা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যরা ধরা পড়বে এমন দৃশ্য কল্পনা করার মতো প্রতিভা আপনাদের কতজনের রয়েছে তা আমি বলতে পারব না-তবে আমার যে নেই তা দিব্যি করে বলতে পারি।
আমার জ্ঞান-গরিমা খুবই সীমিত। কোনকালে পড়েছিলাম পৃথিবীর সবকিছুর শুরু হয় অঙ্ক দিয়ে। গাণিতিক বিচারের পর শুরু হয় জ্যামিতিক মান নির্ণয়। তারপর পদার্থবিদ্যার আলোকে তৈরি হয় কাঠামো-পরবর্তীতে সেই কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই শুরু হয় রসায়ন যা কি না ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের বহু শাখায় বিভক্ত হয়ে আমাদের একটি নির্র্ভুল পরিণতি গণনা করতে শেখায়।
পৃথিবীতে বিজ্ঞানের বাইরে কিছু নেই। ধর্মকর্ম-প্রেম ভালোবাসা যুদ্ধবিগ্রহ রাজনীতি-অর্থনীতি থেকে শুরু করে চুরি-চামারির মধ্যেও উল্লিখিত বৈজ্ঞানিক সূত্র এবং ধারাবাহিকতা অপরিহার্য। যারা জানে তারা মানে এবং সফল হয়। অন্যদিকে যারা জানে না-তারা অলীক স্বপ্ন দেখে কল্পকাহিনি বানায় অথবা তালাশ করে এবং বিজ্ঞানকে অমান্য করে সিনেমা পাঠক তৈরি করে পরিবার, সমাজ, সংসার, রাজনীতি এবং অর্থনীতিকে ভূমি থেকে গ্রেনেড হামলা করে আসমানে পাঠিয়ে দেয়। অতীতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কিংবা মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনরা যে ভুল করেছেন তার সবই ছিল তাদের অজ্ঞতা মূর্খতাজনিত জেদ ক্রোধ এবং প্রতিহিংসাপ্রসূত। বর্তমান সরকার যেন অতীতের ভুল দ্বারা আক্রান্ত না হয় সেজন্যও আমার ক্ষুদ্র বিজ্ঞানচিন্তা নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।
আলোচনার শুরুতেই বলে নিই- ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমি ভিন্নমত পোষণ করি। কারণ আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংগঠন নিষিদ্ধের ইতিহাস বহু পুরনো। ব্রিটিশ জমানা থেকে আজ অবধি আমাদের এ বাংলায় শত শত সংগঠন নিষিদ্ধ হয়েছে।
হাজার হাজার ব্যক্তিকে টার্গেট করে নিষিদ্ধ করে হুলিয়া জারি করা হয়েছে। বহুজনকে মেরে ফেলা হয়েছে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে- অথবা রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিংবা আততায়ী ভাড়া করে অনেককে গুম করা হয়েছে- দেশান্তরী করা অথবা হাত-পা ভেঙে অঙ্গচ্ছেদ করে, পায়ের রগ কেটে, মাথার চুল কেটে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে- নানাভাবে মানুষের মানবিক শক্তির ওপর দানবিক শক্তি প্রয়োগ করে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার অসংখ্য অপচেষ্টা হয়েছে। কিন্তু একটি অপচেষ্টা কোনো ক্ষমতাধরকে সফলতা দিতে পারেনি।
বরং বুমেরাং হয়ে অতীতের অপকর্মগুলো এমনভাবে অভিশাপরূপে ফিরে এসেছে যা অগ্ন্যুৎপাত, সুনামি কিংবা কলেরা, গুটিবসন্তের চেয়েও মারাত্মক মানবিক, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিপর্যয় তৈরি করেছে।
আমাদের চলমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ আরও অনেক কর্মসম্পাদনের জন্য বহুমাত্রিক চাপে ও তাপের কবলে পড়ে রাষ্ট্রীয় নির্বাহী ক্ষমতার পরিবর্তে কবিরাজি পদ্ধতিতে যদি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কিছু সহজ-সরল উপায় অনুসরণ করেন সেজন্য কিছু গাণিতিক জ্যামিতিক জীববিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্রের সূত্র ব্যাখ্যা করব। কারণ রাষ্ট্রশক্তির সরাসরি প্রয়োগ বিশেষ করে ব্রহ্মাস্ত্র অর্থাৎ সরাসরি হুকুম এবং হুকুম মতে পেশিশক্তির ব্যবহারকে আপনি কোনো রোগীর ওপর সরাসরি অস্ত্রোপচারের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। অর্থাৎ অঙ্গহানি ঘটিয়ে বেঁচে থাকা অথবা শরীরের কোনো অশুদ্ধ দূষিত রোগাক্রান্ত অংশ ফেলে দিয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা। এক্ষেত্রে ভাগ্য ভালো হলে অপারেশনের পর রোগী বেঁচে থাকেন বটে কিন্তু জীবনের স্বাভাবিক গতি কোনো দিন ফিরে আসে না। অন্যদিকে বাঁচার জন্য অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে কতজন যে ইহলোক ত্যাগ করেছেন তা গুনে শেষ করা যাবে না।
উল্লিখিত কারণে কোনো ডাক্তারই সরাসরি অপারেশন অনুমোদন করেন না। প্রথমে ওষুধপত্র, খাদ্যাভ্যাস, আহার-নিদ্রা-ব্যায়ামের পরামর্শ দেওয়া হয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ভেষজ পদ্ধতি অর্থাৎ কবিরাজি প্রথা সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত, যেখানে রোগমুক্তির হার বেশি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং ওষুধে কাজ করলে রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। রাজনীতির কবিরাজি চিকিৎসা হলো- রাজনীতির সব স্তরে বৈজ্ঞানিক সূত্র এবং ধাপগুলো অনুসরণ করা যা ইতিপূর্বে আমি বর্ণনা করেছি। সুতরাং অঙ্ক ও জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা এবং রসায়ন শাস্ত্রের আলোকে কীভাবে আওয়ামী লীগ চিরতরে নিষিদ্ধ অথবা দীর্ঘমেয়াদে পরিশুদ্ধ করা যায় তার পদ্ধতিগুলো খাতওয়ারি বর্ণনা করছি- প্রথমত : অঙ্ক ও জ্যামিতিক সূত্র প্রয়োগের মাধ্যমে আপনি আওয়ামী লীগের দফারফা করতে পারেন। সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যত নেতা-কর্মী- সমর্থক রয়েছে তার চেয়ে অন্তত ১০ ভাগ নেতা-কর্মী- সমর্থকসংবলিত একটি দল বা গোষ্ঠী ছাড়া আওয়ামী লীগ নিয়ে চিন্তা, কথাবার্তা কিংবা অ্যাকশন রিঅ্যাকশন শূন্যে হারিয়ে যাবে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের শিক্ষা-দীক্ষা, বল-বীর্য-অর্থ-বিত্ত ইত্যাদির চেয়ে সফল বিচারে উন্নততর লোকজন ছাড়া তাদের নির্মূল অসম্ভব। সংখ্যা এবং মানের যে গাণিতিক বিধান রয়েছে অর্থাৎ শূন্য থেকে ৯ পর্যন্ত সংখ্যাক্রমের তথ্যের সূত্র অমান্য করে জাদু-টোনা, বাণ, তাবিজ-কবজ, ঝাড়ফুঁক কিংবা লাঠি-গুলি, বন্দুক-বারুদ দিয়ে সফলতা আসবে না।
গাণিতিক সূত্রের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করার পর আপনাকে জ্যামিতির সূত্র অনুসরণ করতে হবে। সঙ্গে ভর তথা ওজন তত্ত্ব অনুসরণ জরুরি। অর্থাৎ সারা বাংলার পথে-প্রান্তরে বন-বনান্তরে, পাহাড়-পর্বত, খাল-বিল-নদীতে আওয়ামী লীগের বিস্তৃতির যে পরিমাণ রয়েছে অর্থাৎ দেশের সর্বত্র তাদের যে ঘনত্ব রয়েছে তার চেয়ে যদি আপনার ঘনত্ব একটু বেশি না হয় তবে জ্যামিতির সূত্র কমানোর জন্য আপনি ব্যর্থ হবেন। এরপর আওয়ামী লীগকে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দাঁড়িপাল্লায় উঠিয়ে ওজন করে দলটির ভর মাপার যোগ্যতা থাকতে হবে। দাঁড়িপাল্লার একদিকে যদি ভারযুক্ত পদার্থ যথা সোনা-রুপা, লোহা-তামা ইত্যাদি রাখা হয় আর অন্য পাল্লায় যদি তুলা কর্পূর বাতাস ইত্যাদি রাখা হয় তবে ওজনের ফলাফল কেমন হবে তা বোধ করি বিস্তারিতভাবে বলার প্রয়োজন নেই।
দ্বিতীয় ধাপে এসে আপনাকে ফিজিক্স বা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র অনুসরণ করতে হবে। গাণিতিক ও জ্যামিতিক সূত্রের সফল বাস্তবায়ন শেষে আপনাকে একটা কাঠামো বা স্ট্রাকচার দাঁড় করাতে হবে। সারা বাংলার শহর-বন্দর-নগর-গ্রাম-গ্রামান্তরে আওয়ামী লীগের যে সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে তার চেয়ে চমৎকারভাবে সংগঠন তৈরি করে আপনাকে খুফুর পিরামিড অথবা গিজার পিরামিডের মতো একটি দলীয় পিরামিড তৈরি করে বিজ্ঞানের অর্থাৎ রাজনৈতিক বিজ্ঞানের তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করতে হবে।
তৃতীয় ধাপের রসায়ন ঘটানোর জন্য আপনাকে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আপনি কি প্রতিক্রিয়া ঘটাবেন নাকি ক্রিয়ার চর্চা করবেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের মতো দুর্নাম-বদনাম কামাই এবং আওয়ামী লীগের মতো বিতাড়িত হওয়ার জন্য আপনাকে চাঁদাবাজি-খুন-ধর্ষণ-টেন্ডারবাজি-অনাচার-অবিচার-মিথ্যাচার-ছলচাতুরী, কালোবাজারি, টাকা পাচার, মব জাস্টিস, দখল বাণিজ্য-সিন্ডিকেট বাণিজ্য, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি আওয়ামী লীগের চেয়ে উপরোক্ত দুটি ধাপের সূত্র অনুসরণ করে অবশ্যই ১০ ভাগ বেশি করতে হবে। এক্ষেত্রে আপনার প্রতিক্রিয়া শতভাগ সফল হবে কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। আর আপনি যদি ক্রিয়া করতে চান তবে আওয়ামী লীগ যেসব কুকর্ম করেছে তা করা তো দূরের কথা ওসবের চিন্তাও আপনার মন-মস্তিষ্কে স্থান দেওয়া যাবে না। আপনাকে এমন সব ভালো কাজ করতে হবে- যা আওয়ামী লীগ করেনি- এমন ভালো কথা বলতে হবে যা আওয়ামী লীগ বলেনি এবং এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে যা আওয়ামী লীগ কল্পনাও করতে পারেনি।
আপনি যদি বিজ্ঞানের উল্লিখিত সূত্র প্রয়োগ করে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন তবে আওয়ামী লীগ আপনাকে আব্বা ডেকে প্রাণভয়ে লোকালয় ত্যাগ করে বন-বাদাড়ে চলে যাবে কিংবা দেশান্তরী হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে এবং এ অবস্থার কবলে পড়ে এক দিন দল হিসেবে হারিয়ে যাবে। অন্যদিকে আপনি যদি ক্রিয়া করতে আরম্ভ করেন তবে আওয়ামী লীগ তওবা করে আপনার দলে যোগ দেবে। কিছু লোক অনুশোচনা করে রোগ-শোকের কবলে পড়ে মারা পড়বে। বাকিরা রাজনীতির বাবার নাম ভুলে আমজনতার সারিতে দাঁড়িয়ে দেশ-জাতির কল্যাণে কাজ করবে।
উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনি হবেন কলিকালের রাজনীতির মহাপুরুষ- জাতির নয়া কান্ডারি এবং ইতিহাসের মহানায়ক। আর যদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্র অমান্য করেন তবে হীরক রাজার দেশের সেই খলনায়কের চেয়েও মারাত্মক পরিণতি আপনাকে কেয়ামত পর্যন্ত তাড়া করবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক