জাহীদ রেজা নূর: বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বুঝে চীন আর ভারত নিজেদের সম্পর্কটা ঝালাই করে নিতে চাইছে। দুটি দেশই প্রাচীন সভ্যতার উজ্জ্বল প্রতিনিধি। এরা একজোট হতে পারলে পৃথিবীকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো শক্তি আছে এদের। জনবল এ দুই দেশেরই বড় সম্পদ। বিবাদ ও বিভেদের চক্র থেকে বেরিয়ে এসে সৌহার্দ্য ও শান্তিকে লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করলে চীন-ভারত সম্পর্ক ইতিবাচক হয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। পত্র-পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, পশ্চিমা গণতন্ত্র এখন মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে। এর জন্য সরকারগুলোর জনবিচ্ছিন্নতাকে দায়ী করা হচ্ছে। জনগণ অভিজাত রাজনৈতিক শ্রেণির কাছ থেকে তাদের পাওনা কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নিতে চাইছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উৎসাহী ইউরোপের অনেক দেশই এখন হতাশ। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালার পরও এই যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজিত করার মতো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটও দেখা দিয়েছে। বহু দেশ তাদের সরকার নিয়ে খুশি নয়। যেসব দেশে নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোয় জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে জানিয়ে দিয়েছে, রাজনীতিতে জনবিচ্ছিন্ন করা হলে জনগণই তার জবাব দেবে।
কিন্তু ইতিহাস বলে, ইতিহাস থেকে মানুষ কখনো শিক্ষা গ্রহণ করে না। জনগণ যে প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেয়, নতুন শাসকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। তাই শাসক পরিবর্তন মানেই নতুন সদর্থক কিছু হবেই—এমন আকাঙ্ক্ষা মনে পুষে রাখলেও বাস্তবতা হয়তো ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দেয়। তবে পশ্চিমা জগৎসহ সারা বিশ্বই যে এখন প্রচণ্ড রকম অস্থির হয়ে রয়েছে, সে কথা বলতেই হবে। উগ্র ডানপন্থার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে সর্বত্র। বিশদ পরিসরে তার আলোচনা হওয়া দরকার।
বিশ্বরাজনীতির এই ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্যে সাম্প্রতিক একটি সংবাদ চোখে পড়ল। সংবাদটি আমাদের দেশের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রসঙ্গেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারও সঙ্গেই শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুতা—এ রকম একটি অঙ্গীকার নিয়েই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি তৈরি হয়েছে। অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশও বিদেশি অনেক দেশের কূটনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলে। সেভাবেই চলতে হয়। এই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত ও সৌদি আরবের নাম চলে আসে সর্বাগ্রে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনার জন্ম হয় এবং তাকে কেন্দ্র করেই এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমাদের দেশে যেসব মেগা প্রজেক্টের কাজ হয়েছে, তাতে মূলত ভারত ও চীনের নাম সবার আগে আসে। সেই দুই দেশের বর্তমান সম্পর্কের উন্নতিই আমাদের আজকের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য।
আমরা সবাই বহুদিন ধরে শুনে আসছি, দেখে আসছি, চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক কখনোই সুখকর ছিল না। সীমান্ত সংঘাতসহ নানা সংকট এ দুই দেশকে বৈরী করে রেখেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও চীন দুই ভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। চীন সে সময় বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিল, সে কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। তখন সমাজতান্ত্রিক দুটি বলয়ের একটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল চীন। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে বৈরী ভেবে আঁতাত করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। সমর্থন দিয়েছিল পাকিস্তানকে। কিন্তু বিশ্বরাজনীতি যে সব সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, তারই একটা নজির সৃষ্টি হয়েছে ২২ অক্টোবর।
চীনের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র লিন জিয়ান গত মঙ্গলবার বলেছেন, চীন ও ভারত সীমান্ত সংঘাতের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখছে। কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে দুই দেশ একটা মতৈক্যে পৌঁছেছে।
মনে হতেই পারে, দুই দেশের মধ্যে এই মতৈক্য যেন হঠাৎ করে হয়ে গেল। কিন্তু আদতে ঘটনাটা সে রকম নয়। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অবস্থা বিবেচনা করলে বলা যায় এটাই ছিল এই সময়ে এ দুই দেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয়। তারা যদি একত্রে থাকতে পারে, তাহলে আঞ্চলিক ঐক্য দিয়েই আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে এ দুই দেশ মোকাবিলা করতে পারবে।
উভয় দেশ সীমান্তবর্তী গালওয়ান উপত্যকাসহ পশ্চিম সেক্টরের চারটি বিবদমান এলাকা থেকে সেনা সরিয়ে নিয়েছে। এখন চীন ও ভারতের সীমান্ত এলাকা স্থিতিশীল ও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও সমন্বয়ের স্বার্থে এ দুই দেশ কয়েক ডজন বৈঠক করেছে। সেই বৈঠকগুলোর আলোচনায় তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে যে মতপার্থক্য ছিল, তা কমে এসেছে এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হয়েছে। আলোচনাই তাদের এই ইতিবাচক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। উভয় দেশই বুঝেছে, পারস্পরিক সমঝোতা ও আপসের মাধ্যমেই কেবল কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া সম্ভব। এর কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের মনে পড়ে যাবে, ১২ সেপ্টেম্বর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ই ভান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের উপদেষ্টা অজিত কুমার দোভালের সঙ্গে রাশিয়ার সেন্ট পিতেরবুর্গে আলোচনা করেছিলেন। কী বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন তাঁরা? মতৈক্যে পৌঁছানোর জন্য যা যা করা দরকার, তা নিয়েই দুজন মাথা ঘামিয়েছেন। প্রথমে দ্বিপক্ষীয় সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর করতে চেয়েছেন। এরপর চেয়েছেন দুই দেশের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে। সীমান্ত সংঘাত কাটিয়ে ওঠার প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করেছেন। অন্য কথায়, দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘাত কেটে গেলে এমন কিছু চুক্তি করতে পারবে দুই দেশ, যে চুক্তিগুলো আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে সাহায্য করবে।
চীনের গ্লোবাল টাইমস তার সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘গত চার বছরে চীন-ভারত সম্পর্কের পরিবর্তনের মধ্যে বেইজিং জাতীয় আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সামগ্রিক কাঠামো—উভয়ই রক্ষার জন্য যুক্তিসংগত, সংযত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।
উন্নয়নশীল অর্থনীতির এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যদি সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাহলে দেশ দুটি আন্তর্জাতিক রাজনীতি-অর্থনীতিতেও একসঙ্গে ভূমিকা রাখতে পারবে। সংলাপ, যোগাযোগ, পারস্পরিক বিশ্বাস, বন্ধুত্বপূর্ণভাবে বিতর্কের সমাধান করতে পারলে নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে মনে করে গ্লোবাল টাইমস।
একটু পেছনের দিকে তাকালে যে কেউ দেখতে পাবে, পূর্ববর্তী চারটি বছর ভারত-চীন সম্পর্কে একের পর এক জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি মাথায় রেখে দুই দেশই একটি বাস্তবসম্মত স্থায়ী সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কের কথাই ভাবছে।
চীন মনে করছে, বিগত সময়টিতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করেছে এবং ভাবছে, এর মাধ্যমে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যাবে। ‘ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারত্ব জোরদার’ করার প্রক্রিয়াটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে চীন। ভারতও বুঝতে পারছে, অংশীদারত্বের কথা বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্র মূলত কোনো গ্যারান্টি ছাড়াই চীনের প্রতি ভারতকে বৈরী করে তুলতে চাইছে। বিপরীত দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বের এই রাজনীতি ভারত ও চীনকে পারস্পরিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। কয়েক দশক ধরেই চীন-ভারত সম্পর্ক ভালো নয়। সীমান্ত সংঘর্ষ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তা নয়াদিল্লির জন্য অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা খরচের সম্মুখীন করবে। অকারণে ভারত এই বোঝা মাথায় নেবে কেন? তাই হয়তো দেশ দুটি পরস্পর নৈকট্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝতে পারছে।
দেশ দুটি এ-ও বুঝতে পারছে, চীনা কর্মীদের ভিসার ব্যাপারে ভারতের বিধিনিষেধ কিংবা চীন-ভারতের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল না থাকা কোনো কাজের কথা নয়। ভারত-চীন দুই দেশের নাগরিকই এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে, সংঘর্ষ নয়, সহযোগিতাই আসলে এই মুহূর্তে দেশ দুটিকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে। দুই দেশের শান্তিকামী নাগরিকদেরও সেটাই চাওয়া।
বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বুঝে চীন আর ভারত নিজেদের সম্পর্কটা ঝালাই করে নিতে চাইছে। দুটি দেশই প্রাচীন সভ্যতার উজ্জ্বল প্রতিনিধি। এরা একজোট হতে পারলে পৃথিবীকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো শক্তি আছে এদের। জনবল এ দুই দেশেরই বড় সম্পদ। বিবাদ ও বিভেদের চক্র থেকে বেরিয়ে এসে সৌহার্দ্য ও শান্তিকে লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করলে চীন-ভারত সম্পর্ক ইতিবাচক হয়ে উঠতে পারে।
ব্রিকসের মাধ্যমেও ভারত আর চীন অনেকটা কাছে এসেছে। এখন পরস্পরের কাছাকাছি হওয়ার এই যাত্রাপথ মসৃণ হয়ে ওঠে কি না, সেদিকেই নজর রাখবে গোটা পৃথিবীর সচেতন মহল।
আর আমরা? বাংলাদেশকেও ভারত-চীন সম্পর্কের দিকে সুতীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। নিকট প্রতিনিধি হিসেবে দেশ দুটির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে এই অঞ্চলে। তাদের সঙ্গে সম্মানজনক সম্পর্ক স্থাপন করার সময় বাংলাদেশকেও ভাবতে হবে, কী করে বৃহৎ এই আঞ্চলিক জায়ান্টদের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। আমাদের সম্মান ও স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখেই তা করতে হবে।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা