আবু বাকের মজুমদার : ১৪ জুলাই রাতে ‘রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান ওঠার পর খুনি হাসিনার বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে ১৫ জুলাই দুপুর ১২টায় টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। ১২টা থেকে শিক্ষার্থীরা টিএসসিতে জড়ো হতে থাকে। আগের দিন রাতে বিক্ষোভ হওয়ায় এবং কোপা আমেরিকার খেলা থাকায় ১৫ তারিখের বিক্ষোভ সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম ছিল। অন্যদিকে একই দিনে একই ভেন্যুতে ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম ছিল দুপুর ২টায়। এক পর্যায়ে আনুমানিক দুপুর ১টার দিকে আমাদের কাছে খবর আসে যে হলপাড়ায় শিক্ষার্থীদের আমাদের বিক্ষোভ সমাবেশে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং একদল শিক্ষার্থী এসে জানায় আমরা যেনো হলপাড়ায় গিয়ে বাকিদের নিয়ে আসি।
আমি, নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই কনসাল্ট করে সিদ্ধান্ত নিই হলপাড়ায় যথারীতি আগের মতো যেতে হবে ও আটক শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসতে হবে এবং মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে, আর আসিফ ভাই, নাহিদ ভাই টিএসসিতে থাকেন।
আমরা টিএসসি থেকে আনুমানিক ২০০ শিক্ষার্থী হলপাড়া অভিমুখে একটি রিকশা মাইক নিয়ে রওনা হই। রাস্তায় আমরা স্লোগান দিই ‘বাধা দিলে, বাঁধবে লড়াই! এই লড়াইয়ে জিততে হবে’। যেহেতু আগের দিন খুনি হাসিনা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের নাতি পুতি বলে কটাক্ষ করে, তখন আত্মমর্যাদার প্রশ্নে আমরা ১৪ জুলাই রাতেই সম্মিলিত প্রতিবাদ জানাই। আর তারই ধারাবাহিকতায় সেদিন(১৫ তারিখ) স্লোগানের সময় সকলের মাঝে আত্মমর্যাদার প্রশ্নে প্রতিবাদ ছাড়িয়ে প্রতিরোধের দিকে ধাবমান হওয়ার আগ্রহ ও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। মূলত ওইদিন(১৫ তারিখ) টিএসসি থেকে হলপাড়ার পুরো ঘটনায় মূখ্য স্লোগান ছিলো ‘বাধা দিলে, বাঁধবে লড়াই! এই লড়াইয়ে, জিততে হবে!’
এভাবেই চলতে থাকে আমাদের স্লোগান ও ছাত্রলীগের কাছে আটকে পড়া শিক্ষার্থীদের সাহস যুগিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে আসা। একইভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে যাই ও শান্তিপূর্ণভাবে স্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসি।
তৃতীয় হল হিসেবে বিজয় একাত্তর হলের সামনে আসি। আনুমানিক তখন দুপুর ১টা ৪৫ বাজে। বিজয় একাত্তর হলের সামনে যাওয়া মাত্রই ছাত্রলীগের ৬/৭ জন এসে সামনে দাঁড়ায় এবং আমাদের স্লোগান দিতে বাধা দেয়। আগের রাতে (১৪ জুলাই) যখন সারা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা স্লোগানে স্লোগানে বের হয়ে আসছিল, তখনও তারা (ছাত্রলীগ) বিজয় একাত্তর হলে আমাদেরকে বাধা দেয়। ‘মূলত হামলার সূত্রপাত হয় ১৪ তারিখ রাতেই’। যখন আমি আর আসিফ ভাই সামনে দাঁড়িয়ে ওই রাতে বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের বাধাকে অতিক্রম করে শিক্ষার্থীদের হলের ভেতর থেকে নিয়ে আসার চেষ্টা করি, তখন একদল আমাদের দুজনকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে এবং আমাদের হাতে থাকা হ্যান্ডমাইক কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। যে ছেলেটা হ্যান্ডমাইক টান দেয় তাকে আমি পেছনের দিকে টান দিয়ে নিয়ে আসি এবং আমাদের সাথের শিক্ষার্থীরা তাকে জসিম উদ্দিন হলের মাঠে নিয়ে যায়। অন্যদিকে আসিফ ভাই হল গেটে একা হয়ে যাওয়ায় পরবর্তীতে একই সময়ে ভাইয়ের ওপর আক্রমণ করে এবং উনি এক পর্যায়ে মাটিতে পড়ে যান। তাকে বেধড়ক কিল, ঘুষি, লাথি মারে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ। ওই হামলার নেতৃত্ব দেয় বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের শাকিরুল।
১৪ তারিখের ধারাবাহিকতায় ১৫ তারিখেও বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগ আমাদের ওপর পরিকল্পিত হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু আমাদের তা জানা ছিল না। আমাদেরকে যখন হল গেটে বাধা দেয় তখন আমাদের স্লোগান ছিলো একটাই, ‘বাধা দিলে, বাঁধবে লড়াই! এই লড়াইয়ে জিততে হবে’।
আমি ফ্রন্টে থাকায় ছাত্রলীগের একজন এসে আমাকে ধাক্কা দেয়, আমাকে ধাক্কা দেওয়ায় আমার আশেপাশের সহযোদ্ধারা সামনে এগিয়ে যায় ও বাধা অতিক্রম করে হল গেটের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে ও বাকিদের আসার আহ্বান করে। তখন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন আমাদের সাথে টানাহেঁচড়া শুরু করে ও হল থেকে বের হয়ে যেতে বল প্রয়োগ করে। তখনো আমরা স্লোগান দিচ্ছিলাম, ‘বাধা দিলে, বাঁধবে লড়াই! এই লড়াইয়ে জিততে হবে’। তারপর ওপর থেকে আমাদেরকে টার্গেট করে কাচের বোতল নিক্ষেপ শুরু হয়, আমাকে টার্গেট করে (যেহেতু আমার হাতে মাইক ছিলো) ৪/৫টা বোতল নিক্ষেপ করে, তখন আমার পাশে থাকা একজনের মাথা ফেটে যায়। আমাদের একাংশ ছাত্রলীগের হামলার প্রতিরোধ করতে গিয়ে উপস্থিত ছাত্রলীগের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে যায়।
এক পর্যায়ে শুরু হয় হলের ওপর থেকে ছাত্রলীগের উপুর্যুপরি ইট নিক্ষেপ এবং আরেক দল লাঠিসোঁটা নিয়ে চলে আসে নিচে(হলের আঙিনায়) আমাদেরকে টার্গেট করে আক্রমণ করার জন্য। আমাদের দুইজনের মাথা ফাটে এবং একজনের হাত ভেঙে যায়। তখন উপস্থিত আমরা সর্বাত্মক প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেই ও হলের আঙ্গিনায় কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।
ওপর থেকে আসা ইটের সামনে দাঁড়াতে না পেরে আমরা একপর্যায়ে পিছু হটি। তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রলীগের ৩০/৩৫ জনের একটি গ্রুপ লাঠিসোঁটা ও ইট-পাটকেল নিয়ে সামনে দৌড়ে আসতে থাকে এবং এলোপাতাড়ি আমাদের ওপর আক্রমণ করতে থাকে। আমাদের কিছু সহযোদ্ধা মল চত্ত্বরের দিকে অগ্রসর হয়।আমাদের কেউ আটকা পড়েছে কিনা এটা দেখতে আমি সামনে এগিয়ে যাই। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে টার্গেট করে ৩০/৩৫ জন একসাথে ইট নিক্ষেপ করে ও আমার দিকে লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসতে থাকে। আমি মাইক ফেলে মাথার পেছনে হাত দিয়ে জসিম উদ্দিন হলের দিকে দৌড় দিই। আমার পেছন সাইডে (পায়ে,পিঠে) বেশ কয়েকটা ইট লাগে। ওরা মূলত শুরু থেকেই আমাকে নানাভাবে টার্গেট করছিলো। জসিম উদ্দিন হলে প্রবেশের পর কোনো রাস্তা না পেয়ে, হলের পশ্চিম পাশের দেয়াল টপকানোর চেষ্টা করে প্রথমবার ব্যর্থ হই। অন্যদিকে ছাত্রলীগ আমার দিকে দৌড়ে আসছে। পেছনে ফিরে দেখি সর্বোচ্চ ৫০/৬০ মিটার দূরে দৌড়ে আসতেছে, আর আমাকে লক্ষ্য করে ইট মেরে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ধাপে চেষ্টা করে দেয়াল টপকাতে সফল হই। আগে কমবেশি এথলেটিক এর সাথে ছিলাম বলে কাজটা তূলনামূলক সহজ হয়েছিল। দেয়ালের অন্যপাশে পড়েই মাটিতে থাকা অবস্থাতেই আসিফ ভাইকে কল দিয়ে বলি, ‘ভাই, আমাদেরকে ছাত্রলীগ আক্রমণ করেছে, কয়েকজনের মাথা ফেটেছে।’ ভাই বলেন, ‘দাঁড়াও আমরা আসতেছি।’ আসিফ ভাইয়ের এ কথা শুনে আরো সাহস পাই এবং আমি দুই/তিন জনের সহযোগিতায় (রাস্তা না চিনার কারণে) দেয়ালের ওপাড় থেকে বের হয়ে এসে মল চত্ত্বরের দিকে যাই এবং সেখানে পুনরায় উপস্থিত বাকিদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। আনুমানিক দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যে আসিফ ভাই, নাহিদ ভাই সহ বাকিরা মিছিল নিয়ে মল চত্ত্বর আসেন।
লেখক: অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন