সমতট ডেস্ক।।
সুবিশাল প্ল্যাটফর্মে যাত্রী বসার বেঞ্চি। দৃষ্টিনন্দন ফুট ওভারব্রিজ, টিকিট বিক্রয় কক্ষ, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, অপেক্ষাগার থেকে শৌচাগার– সবই পরিপাটি। তবে যে কারণে এত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, এত আয়োজন, সেই ট্রেনই ‘অনুপস্থিত’! প্ল্যাটফর্মের সামনে দিয়ে নিত্যদিন হুইসেল বাজিয়ে যাচ্ছে-আসছে ট্রেন, কিন্তু থামে না। এমন তিন বিলাসী রেলস্টেশনের খোঁজ মিলেছে কুমিল্লায়। আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) মন্ত্রী থাকাকালে শখের বশে নিজের নির্বাচনী এলাকায় স্টেশনগুলো নির্মাণে ‘অযাচিত ভূমিকা’ রেখেছিলেন।
সবকিছু সাজিয়েও স্টেশন চালু না হওয়ায় গেল এক বছরে বেশ কিছু যন্ত্র, জংশন বক্স ও কেবল চুরি হয়ে গেছে। জনবল না থাকায় মূল্যবান অনেক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, আধুনিক স্টেশন ও রেলপথ নির্মাণে বিপুল টাকা খরচা হলেও আদতে গেল সাড়ে ১৫ বছরে যাত্রীসেবার উন্নতি হয়নি। যদিও নিজ এলাকায় রেলস্টেশন নেওয়ার বিষয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মন্ত্রী-এমপিরা প্রতিযোগিতায় নামতেন।
এমন পরিস্থিতিকে রেলওয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনাহীনতার চরম পর্যায়ে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘রেল ঘিরে বিক্ষিপ্ত উন্নয়ন হয়েছে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের চূড়ান্ত উদাহরণ হলো জনবল চূড়ান্ত না করে নতুন স্টেশন তৈরি করা। যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের আগে কেন করা হবে– এ বিষয়ে বিশদ গবেষণা হয়। প্রয়োজন থাকলেই কেবল প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এখানে স্টেশন নির্মাণ হয়েছে, অথচ কোনো কাজে আসছে না। অর্থ অপচয় করে এমন প্রকল্প মেনে নেওয়া যায় না।’
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় আখাউড়া-লাকসাম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে শুরু হয় নির্মাণকাজ। ২০২০ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কয়েক দফায় সময় বাড়ানো হয়। পরে ২০২৩ সালের ২০ জুলাই আখাউড়া-লাকসাম রেল অংশের ডাবল লাইন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার অংশে আগে একক লাইন ছিল।
৬ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় সেটিকে ডাবল লাইন করা হয়। চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন এবং বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার যৌথভাবে প্রকল্পের কাজ করে। এর আওতায় কম্পিউটারাইজড সিগন্যাল ব্যবস্থাসহ ১১টি নতুন স্টেশন ও ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়। দুটি স্টেশন করা হয় আধুনিকায়ন। এর মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের সুপারিশে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় তিনটি নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হয়। তখন তিনি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী। প্রকল্প অনুমোদনের সময়ে রেলপথমন্ত্রী ছিলেন কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসনের এমপি মুজিবুল হক। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার তিনটি স্টেশন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করে।
আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইনের প্রকল্প পরিচালক মো. তানভিরুল ইসলাম বলেন, ‘নতুন স্টেশন ও ডাবল রেললাইনের প্রকল্পের কাজ শেষ। প্রয়োজনীয় জনবল সংকটে কিছু নতুন স্টেশন থেকে যাত্রীসেবা মিলছে না।’
তিন রেলস্টেশন এখন কেমন
কুমিল্লার সদর দক্ষিণের ময়নামতি রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, পাশে জাঙ্গালিয়া আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও সিএনজি স্টেশন। শহরের অনেকটা কাছাকাছি হওয়ায় চাহিদা ও গুরুত্ব না থাকায় এক যুগ আগে বন্ধ করে দেওয়া হয় এ স্টেশন। ‘অপ্রয়োজনীয়’ হলেও লোটাস কামালের ইচ্ছায় নতুন করে সেজেছে স্টেশনটি।
একই অবস্থা লোটাস কামালের বাড়ির অদূরে লালমাই রেলস্টেশনে। সেখানকার স্টেশন মাস্টার কাজী আবদুল মান্নান জানান, এখানে ২০২১ সালের শেষ দিকে যোগ দেন। জনবল তিনিসহ তিনজন। এ স্টেশনে এখন শুধু লোকাল ট্রেন নাসিরাবাদ যাত্রাবিরতি দেয়। তবে জনবল সংকটে টিকিট বেচা সম্ভব হয় না। দূরের কিছু যাত্রী এসে নামেন। আগে ভৈরব লোকাল ট্রেন থামলেও ২০১০ সাল থেকে তা বন্ধ।
স্টেশনটি দেখভাল করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের কর্মচারীরা। কর্মরত আশরাফ আলী জানান, রেলওয়ের কর্মচারী না থাকায় তারা সাতজন পাহারা দিচ্ছেন। তবু নিয়মিত চুরি হচ্ছে যন্ত্রপাতি।
এলাকার বাসিন্দা কলেজছাত্র তোফায়েল বলেন, ‘পাশেই বাসস্ট্যান্ড ও কুমিল্লা রেলস্টেশন থাকার পরও এখানে বিপুল টাকা খরচ করে কার স্বার্থে এই স্টেশন করা হলো, আমরা জানি না। জন্মের পর দেখিনি এ স্টেশনে ট্রেন থামতে।’
লালমাই উপজেলার আলীশহর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, প্ল্যাটফর্মে ধান শুকাচ্ছেন এলাকার লোকজন। স্টেশন অফিসের দরজা-জানালা বন্ধ। নেই রেলওয়ের কোনো কর্মচারী। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের কর্মচারী প্রদীপ দাস জানান, রেলের নিযুক্ত কেউ এখানে নেই। তাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নির্দেশে দু’জন মিলে তারা পাহারা দিচ্ছেন।
স্টেশনটির পাশের বাড়ির বাসিন্দা আবদুল খালেক বলেন, ‘ট্রেন না থামলেও এলাকার লোকজন ও স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীর কাছে এ স্টেশন একটি বিনোদন কেন্দ্র। ছেলেমেয়েরা এখানে ঘুরতে এসে মোবাইলে টিকটক ভিডিও করে।’
রেলওয়ের (কুমিল্লা) সিনিয়র উপসহকারী প্রকৌশলী (সিগন্যাল) আহমদ আলী বলেন, ‘ওই তিনটি স্টেশন নিয়ে আমাদের প্রতিদিন টেনশনে থাকতে হয়। জনবল না থাকায় মূল্যবান অনেক যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
জানতে চাইলে রেলওয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এ কে এম কামরুজ্জামান বলেন, ‘যাত্রীসেবার মান উন্নয়নে রেলপথ ও আধুনিক স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। জনবল নিয়োগ দেওয়ার পর ময়নামতি, লালমাই ও আলীশহর স্টেশনে কোনো ট্রেন থামানো যায় কিনা, আমরা তা সমীক্ষা করব। এখানে যাত্রীদের চাহিদার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
পলাতক থাকায় এ বিষয়ে কুমিল্লা-১০ আসনের সাবেক এমপি আ হ ম মুস্তফা কামালের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।