ড. নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ: আসছে ১৮ নভেম্বর ইংল্যান্ডের লেখক, নাট্যকার, আমলা ও আইন প্রণেতা জন লিলির ৪১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হবে।৪১৮ বছর আগে মৃত্যুবরণ করলেও তিনি অমর হয়ে আছেন মানব-মানবীর প্রেমকে উপজীব্য করে তার লেখা বেশ কিছু নাটকের জন্য।
১৫৭৯ সালে দি অ্যানাটমি অব উইট রসিকতার বিশ্লেষণ নাম অব গদ্য সংকলনের একটি অংশে তিনি লিখেছিলেন নিখুঁত খেলার নিয়ম প্রেম ও যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই কথাটি পরবর্তীকালে ইংরেজি ভাষার ক্রমবিবর্তনে এমন অর্থ প্রকাশ করে যে, ‘প্রেম ও যুদ্ধে সবই বৈধ’। কথাটির পরিবর্তিত এ রূপই বহুল জনপ্রিয়তা পায়।
জন লিলির মতোই বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে ভারতে জন্মেছিলেন পূর্ণেন্দু শেখর পত্রী (ছদ্মনাম সমুদ্রগুপ্ত)। জন লিলির ৩৭৭ বছর পর জন্ম নেওয়া পূর্ণেন্দু কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য ও গবেষণাপত্র লিখে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে তার নিপুণ পরিচালনায় ও হাতের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ হয়েছে কলকাতাভিত্তিক বাংলা চলচ্চিত্র এবং প্রকাশনা শিল্পের অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ। বাঙালি প্রেমিক-প্রেমিকাদের মনে গেঁথে আছে পূর্ণেন্দুর কথোপকথন সিরিজের ১১তম কবিতায় বর্ণিত প্রেমিক শুভঙ্কর ও তার প্রেমিকার খুনসুটি। কবিতার শেষে প্রেমিকা যখন তার শাড়ি ধরে টানার প্রসঙ্গ তোলে, তখন শুভঙ্করের উত্তর ছিল—‘ভিখারিদের ডাকাত হতে ইচ্ছে করবে না একদিনও?’
প্রেম কিংবা যুদ্ধের ক্ষেত্রে সবকিছুর বৈধতা দেওয়া দোষের কিছু নয় হয়তো বা। শুধু প্রেমের কারণেই যদি কোনো প্রেমিক ডাকাত হয়ে যায়, তাহলে তেমন কিছু বলার থাকে না। তবে এমন প্রেম যদি অর্থবিত্তের জন্য হয় আর তা পেতে যদি পিয়ন বুয়ার ড্রাইভার ক্লিনার সবাই ডাকাত হয়ে যায়, তখনই বাধে বিপত্তি। বিগত প্রায় ১৬ বছর বাংলাদেশে এমন বিপত্তিতেই ছিল। স্বৈরাচারী এরশাদ শাসক আমলে একশ্রেণির বাংলা সংবাদপত্র প্রথম পাতায় এরশাদের লেখা কবিতা ছাপাতে শুরু করলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক ও খ্যাপাটে কবি মুহাম্মদ রফিক লিখেছিলেন—‘সব শালা কবি হবে পিঁপড়ে গউ ধরেছে উড়বেই’। সেই এরশাদ ক্ষমতা ছেড়েছেন প্রায় ৩৩ বছরেরও বেশি। এবার ৪০০ কোটি টাকার মালিক এক পিয়নের হেলিকপ্টারে উড়াল দেওয়ার গোঁ-ধরার কথা জানান দেন বিগত সরকারের খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যেসব কারণে বিগত সরকার সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল, তার অন্যতম বিদেশ সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী তথাকথিত সংবাদ সম্মেলনের নামে বিতর্কিত সাংবাদিকদের মধ্যে তোষামোদির উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন। এমনি এক আয়োজনে দুর্নীতি প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন—‘আমার বাসার কাজ করে গেছে যে পিয়ন, সে এখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। কী করে বানাল টাকা? যখন আমি জানছি, তাকে বাদ দিয়ে তার কার্ডটা সিজ করে আমার ব্যবস্থা আমি নিছি। এটা তো হয়। এটা তো করে…।’ শেখ হাসিনার বাসায় কাজ করা জাহাঙ্গীর নামের সেই পিয়নের মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর হওয়ার এবং তাজমহল গড়ার গোঁ ধরেছিল। হতে চেয়েছিলেন জনপ্রতিনিধিও। তাই চাঁদাবাজি আর তদবির বাণিজ্যের সুবাদে পিয়ন থেকে নোয়াখালীর চাটখিলের মিলিয়নিয়ার বনে যান। শুধু কার্ড সিজ করেই তার প্রতি যেন ন্যায্য বিচার করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বাসভবন থেকে বিতাড়িত একটি বিতর্কিত পিয়ন কী করে সে জনসমক্ষে ঘুরে বেড়াল এবং জানামতে বিদেশে চলে গেল, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই কারও কাছে। ওই সংবাদ সম্মেলনের কোনো সাংবাদিক এ নিয়ে টুঁ-শব্দটিও করেননি বরং প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিবিরোধী তথাকথিত জিরো টলারেন্সের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। অথচ স্বৈরাচার এরশাদের আমলে এক সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক সরাসরি রাষ্ট্রপতি এরশাদকে বলেছিলেন, সংবাদপত্রের প্রথম পাতা সংবাদ ছাপানোর জন্য, কোনো কবিতা ছাপানোর জন্য নয়। কবিতা ছাপানো হয় ভেতরের পাতায়। আপনার দপ্তর থেকে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় কবিতা ছাপানোর কোনো আদেশ কি দেওয়া হয়েছে? অন্যদিকে ব্যাপকভাবে প্রচার পায় যে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির গৃহকর্মী বা কেয়ারটেকার থেকে প্রথমে সংসদ সদস্য এবং পরে জাতীয় সংসদের হুইপ বনে যান মাহবুব আরা বেগম গিনি। ৩২ নম্বরের আরেক কেয়ারটেকার ও তারই ভাই টুটুল এবং কিছু নিকটাত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে গাইবান্ধার যাবতীয় সরকারি কাজ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করে কোটিপতি খাতায় নাম লেখান এই গৃহকর্মীও।এ বছর ১ অক্টোবর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১ অক্টোবর, ২০২৪)
কাজের বুয়ার সঙ্গে গাড়িচালকদের রসায়ন নিয়ে উপমহাদেশে বহু চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশে দুর্নীতির ক্ষেত্রেও দেখা যায় বুয়া আর গাড়িচালকদের রসায়নে চমৎকার মিল। উভয়ের প্রেম শুধুই টাকা আর বিত্তবৈভবের জন্য। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের গাড়ির চালক ছিলেন সৈয়দ আবেদ আলী। তারও আগে তিনি ছিলেন একজন কুলি। তবে ১২ বছরে বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৮ জুলাই তিনি যখন গ্রেপ্তার হন, কেবল তখনই জানা যায় যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিনিময়ে অর্জিত টাকায় কোটিপতি বনে যান একজন আবেদ আলী ড্রাইভার। আরেক গাড়িচালক মালেকের জীবনালেখ্য আরও চমকপ্রদ। রাজধানীর তুরাগ থানাধীন কামারপাড়ায় সাততলা প্রাসাদে বসবাসকারী মালেক ছিলেন সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, পেশায় গাড়িচালক।কাগজে-কলমে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক হলেও বাস্তবে যেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরই চালকের আসনে বসে যান এই মালেক। কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, ক্রয় অর্থাৎ অর্থসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে একচ্ছত্র প্রভাব ছিল মালেকের। সেইসঙ্গে অবৈধ অস্ত্রব্যবসা, চাঁদা আদায় ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে ড্রাইভার মালেক শতকোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠেন। তবে ২০২০ সালে একপর্যায়ে এসে তিনি গ্রেপ্তার হনর্যাবের হাতে।
শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্যই নয়, সরকারি টাকা তথা জনগণের টাকা অবৈধভাবে কুক্ষিগত করা এবং তথাকথিত ব্যবসায়ীর নেকনজরের বরকতে তার বাড়ির কাজের বুয়ারও কোটিপতি হওয়ার ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে অর্থনৈতিক লুটপাটের কারণে সবচেয়ে কুখ্যাত ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের টাকা পাচারকারী এস আলমের বাড়ির গৃহপরিচারিকার নাম ছিল মর্জিনা। ভাগ্যবতী এই গৃহপরিচালিকার স্থায়ী আমানত ও ব্যাংকের চলতি হিসাবে পাওয়া গেছে কোটি কোটি টাকা। আলিবাবা চল্লিশ চোর নামের আরব্য উপন্যাসে মর্জিনা নামের এক সুন্দরী নর্তকী নাচেগানে ডাকাতদের ভুলিয়ে রেখেছিল আলিবাবার সম্পদ বাঁচানোর জন্য। কিন্তু এস আলমের মর্জিনার অ্যাকাউন্টে কেন এত টাকা রাখা হলো, এ রহস্যের উদঘাটন আজও হয়নি।
আবার পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা ক্লিনার থেকে এ দেশে কোটিপতি হওয়া মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দৈনিক মজুরিভিত্তিক ক্লিনার গনি মিয়া তাদেরই একজন। মূলত চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে জমি দখল ও ভাড়া প্রদান, পোস্টিং, টেন্ডার বাণিজ্য প্রভৃতি তার ভাগ্য খুলে দেয়।এ ছাড়া কর্মচারী সমিতির টাকা তছরুপের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।অশিক্ষিত মোহাম্মদ আলী ছিলেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে বিমান পরিষ্কারের দায়িত্বে নিয়োজিত। তিন বছরের মাথায় চোরাচালান চক্রের সঙ্গে দক্ষতা গড়ে উঠলে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।তবে এখন তিনি আছেন জেলে। মফস্বল জেলা কিশোরগঞ্জের ইসলামী ব্যাংকে ক্লিনার হিসেবে কাজ করতেন মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম ও তার স্ত্রী মোসাম্মৎ রেখা। আজ তারা কোটিপতি দম্পতি। এর নেপথ্যে রয়েছে ব্যাংকবিষয়ক জালিয়াতি ও প্রতারণা। অন্যদিকে রাজধানীর এক হোটেলের ক্লিনার থেকে দেহব্যবসা ও মানব পাচার পুঁজি করে হোটেল মালিক ও কোটিপতিতে পরিণত হন মিরপুরের মারুফ হায়দার।
অর্থনৈতিক দৈন্য জয় করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কোনো দোষের কিছু নয়। বরং নিজ পরিশ্রম ও মেধার বদৌলতে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখাই বাঞ্ছনীয়। পৃথিবীর বহু দেশে শূন্য থেকে শীর্ষ ধনীতে পরিণত হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশেও এমন উদাহরণ কম নয়। তবে তার প্রতিটির পেছনেই ছিল সততা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম ও দায়িত্ববোধের এক জীবন্ত ইতিহাস। কিন্তু গত ১৬ বছরে আমরা যা দেখেছি, তা রীতিমতো ভীতি-জাগানিয়া। রীতিমতো ডাকাতি করেই যেন কোটিপতি হওয়ার নেশা চেপে বসেছিল একদল মানুষরূপী হায়েনার। অতীতের ভুল থেকে এ সমাজ সংশোধিত হবে এবং ভবিষ্যতে এমনটি আর ঘটবে না, এমনটাই হোক আমাদের অহংকার অঙ্গীকার।
লেখক: গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট