সমতট ডেক্স: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বছরের শেষ দিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ উন্মোচনের ডাক দিয়েছে। তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। রোববার সংবাদ সম্মেলন করে তারা এ বার্তা দেয়। এটি জনমনে একই সঙ্গে উৎসাহ, উৎসুক্য ও উৎকণ্ঠার উদ্রেক করেছে। এ পরিস্থিতি দেখে জগজিৎ সিংয়ের কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গানটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে– ‘আজ কিছু হতে চলেছে, সে আমায় কথা দিয়েছে।’
৩১ ডিসেম্বর আসলে কী হতে চলেছে? প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মো. শফিকুল আলম ইতোমধ্যে বলেছেন, এটি শিক্ষার্থীদের ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগ’। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো যুক্ততা নেই। সরকারের এমন বক্তব্যে মানুষের আগ্রহ ও সংশয় দুটোই বেড়েছে। তবে গত কয়েক মাসের পরিস্থিতি থেকে এ নিয়ে কিছু বিষয় বোঝা একেবারে অসম্ভব কিছু নয়।
রাষ্ট্র একটি জটিল বিষয়। এখানে থাকে নানা স্বার্থগোষ্ঠী। অর্থাৎ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লুফে নেওয়ার যেমন লড়াই, তেমনি মত, পথ ও ভাবাদর্শ কায়েমেরও লড়াই। এখন দেশের মানুষ সেই পরিস্থিতির মধ্যেই এবং কিছুটা দ্বিধান্বিত সময় পার করছে। গণঅভ্যুত্থানের আগে ও পরের পরিস্থিতি একই রকম থাকে না। চারদিকে অনিশ্চয়তা ও সংশয়! প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ কোন দিকে হাঁটছে– এটাই এখন সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা গত ৫৩ বছরের শোষণ ও বৈষম্যভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা উপড়ে ফেলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েমের ডাক দিয়েছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে তা নানা তৎপরতায় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আমরা শুরু থেকেই নাগরিক সমাজে আন্দোলন, বিপ্লব নাকি অভ্যুত্থান– এ নিয়ে বহু তর্ক দেখেছি। এ থেকে ৩১ ডিসেম্বর নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষার্থীরা এই ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করতে যাচ্ছে কি?
এর সুস্পষ্ট উত্তর এখনও অজানা। সংবাদমাধ্যমে যেসব প্রতিবেদন এসেছে, তাতেও যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে। সমন্বয়করা সংবাদ সম্মেলনে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে ‘মুজিববাদী’ আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে তারা কিছু দাবি তুলতে পারে। যেমন– অভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের হত্যা ও নিপীড়নকারীর বিচার, বিদ্যমান শোষণভিত্তিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত উপড়ে ফেলতে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস, সংবিধান সংস্কার কিংবা পুনর্লিখন; এমনকি তারা সেদিন রাজনৈতিক দল হিসেবেও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারে।
এ নিয়ে রাজনৈতিক মহল ও নাগরিক সমাজে নানা মত দেখা দিয়েছে। অনেকে এ উদ্যোগকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। আবার অনেকে এতে সমস্যা বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দেন। বিশেষত রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে এ ধরনের ঘোষণাপত্র দেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করা জরুরি বলে মনে করেন। যেখানে শিক্ষার্থীদের অন্যতম প্রধান দাবি বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্ত উপড়ে ফেলা, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে ঘোষণাপত্র তুলে ধরার সম্ভাবনা কখনও ছিল না। বিএনপি নেতারা নির্বাচিত সরকার গঠন করে ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়’ এগোতে হবে বলে জোর দেন। আবার জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শিক্ষার্থীরা নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীরা রাজনীতির মাঠ থেকে শিক্ষাঙ্গনে ফিরে গিয়েছিল; কিন্তু এবারের বাস্তবতা তার উল্টো। তারা নতুন বন্দোবস্তের ডাক দিয়েছে। এতে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের মতবিরোধের প্রধান জায়গা মত, পথ ও ভাবাদর্শ। ফলে রাজনীতিতে আগের যে কোনো আন্দোলন-পরবর্তী সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। তবে শিক্ষার্থীরা যদি সামাজিক সুবিচার সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েমের পথে তৎপর থাকে, তাতে জনগণ তাদের ডাকে সাড়া দিতে পারে। তাই জগজিৎ সিংয়ের সেই গানটা দিয়েই শেষ করি– ‘আজ কিছু হতে চলেছে, সে আমায় কথা দিয়েছে। আজ কিছু হতে চলেছে।’