সমতট ডেক্স: শেখ হাসিনার শাসনকালে দেশের আলেম-ওলামা ও ধর্মীয় নেতাদের দিন কাটতো আতঙ্কে। আতঙ্ক নিয়েই পবিত্র রমজান মাসে সেহরি খেয়ে ঘুমিয়েছিলেন মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই দেখেন তার বাসা ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। কোনো মামলা ও কারণ ছাড়াই আটক করে সোজা নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি অফিসে। সেখানে ভিত্তিহীন কিছু মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে একটানা ২৬ দিন রিমান্ডে রাখা হয় তাকে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ আর চরম মানসিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। তাকে রাখা হয় অজ্ঞাত স্থানে। রিমান্ডের বিভীষিকাময় পরিবেশেই তারাবির নামাজসহ রোজা রাখতে হয় তাকে। এভাবে ১১ মাস জেলখানায় ছিলেন তিনি।
শুধু জালালুদ্দীন আহমদই নন, একই সঙ্গে এমন পরিস্থিতির শিকার হন আরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ আলেম। কারণ, তারা রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভাস্কর্যের নামে ‘মূর্তি’ স্থাপনের বিপক্ষে কথা বলেছিলেন। ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ধর্মপ্রাণ মানুষের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। আর এসব আন্দোলন দমনে নির্মমপন্থা বেছে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। আলেম-ওলামাদের ওপর হাসিনা সরকারের জুলুম-নির্যাতনের প্রত্যক্ষ একজন সাক্ষী হন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস যুগ্ম মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামীর মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ। বর্তমানে তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত বাইতুল ফালাহ মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছেন।
আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই আলেম-ওলামারা নির্যাতিত হয়েছেন। তারা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে জঙ্গি জুজুর নাটক সাজিয়ে আলেমদের ওপর অনেক অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। এমনকি কুকুরের মাথায় টুপি দিয়ে তারা পোস্টারও ছেপেছিল। ১৯৯৯ সালে একটি হরতাল কর্মসূচি ঘিরে মোহাম্মদপুরের নুর মসজিদে পুলিশ নিজেরাই একজনকে হত্যা করে মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রখ্যাত আলেম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ও মুফতি ফজলুল হক আমিনীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের হ্যান্ডকাফ ও ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। গ্রেপ্তারের পর তাদের অজুর পানি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। সেই মামলায় আমিও আসামি থাকায় কয়েক মাস পালিয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আগের অভ্যাস অনুযায়ী, অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। আসলে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ লোক ইসলামকে সহ্যই করতে পারে না। এভাবে দীর্ঘ ১৫ বছর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে তারা।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালে ১৩ দফা দাবিতে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে রাতের আঁধারে নির্মমভাবে আক্রমণ, অনেককে হত্যা ও আহত করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। শহিদদের দাফনেও বাধা দেয় আওয়ামী লীগের লোকেরা। আহতরা ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারেননি। আহত অনেকে এখনও দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন।’
মাওলানা জালালুদ্দীন বলেন, ‘২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে দেশে মূর্তি স্থাপনের উদ্যোগ নিলে আমরা তাতে বাধা দিই। এছাড়া স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে গুজরাটের কসাইখ্যাত নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু সরকার তা শোনেনি। এই ইস্যুতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ২৫ হাজারের ওপরে আলেম-ওলামা কারাবরণ করেন। অনেকে আত্মগোপনে থাকেন। আমাদের অনেকেই দুই-তিন বছর কারাগারে দুর্বিষহ জীবন কাটান।’
মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষদের দমনে জঙ্গি নাটক সাজানো হতো। পশ্চিমাদের দয়া-দাক্ষিণ্য পেতে তারা এটা করতো। আসলে আমাদের মধ্যে কোনো জঙ্গিবাদ নেই। তারা ইসলামপন্থি, আলেম-ওলামাদের গ্রেপ্তার করে ডিবির টর্চার সেলে আটকে রাখতো। যখন মনে করতো, তখন তাদের মিডিয়ার সামনে হাজির করে বলতো, অমুক পাহাড় থেকে তাদের গ্রেপ্তার করেছি। আসলে তারা ছয় মাস আগেই গ্রেপ্তার হয়ে ডিবির কাছে ছিল। এভাবে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে পুলিশ বহু যুবকের জীবন শেষ করে দিয়েছে। জঙ্গি নাটক ছিল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল। তারা চিন্তা করতো ইসলামপন্থিদের দমনের জন্য এটা একটা বড় হাতিয়ার।’
নিজের গ্রেপ্তার হওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, “২০২১ সালে ৩ রমজান সেহরি খেয়ে বাসায় ঘুমিয়েছিলাম। সকাল ১০টায় ঘুম থেকে উঠে দেখি বাসা ঘেরাও করে রেখেছে পুলিশ। কোনো মামলা ছাড়াই আমাকে ধরে ডিবি অফিসে নিয়ে গেল। পরে ২০১৩ সালের হেফাজতের ঘটনার মামলায় গ্রেফতার দেখায়। নেওয়া হয় রিমান্ডে। ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তৎকালীন ডিবিপ্রধান মাহবুবুর রহমান এবং তার সঙ্গে চারজন এসপি পর্যায়ের পুলিশ অফিসারের সামনে আমাকে বসানো হয়। তাদের ভাষা ছিল খুবই নোংরা। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ‘ডিম ঢোকানোর’ হুমকি দেয়।”
তিনি বলেন, ‘ডিবি গারদে প্রচণ্ড গরম, কোনো ফ্যান নেই। তিন-চারজন থাকার মতো একটি রুমে ১১ জনকে রাখা হয়। আমরা ঠিকমতো শুতে পারিনি। একজনের মুখের দিকে আরেকজনের পা দিয়ে শুতে হতো। সেখানে তারাবির নামাজ পড়ার সময় ঘামে কাপড় ভিজে যেত, নামাজ শেষে কাপড় চিপে ঘামের পানি বের করতাম। একটানা ২৬ দিন রিমান্ডে ছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিকভাবে চরম অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়। রিমান্ডে যেসব বিষয় জিজ্ঞাসা করা হয় তা হাস্যকর। বিএনপির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে কি না, আমাদের আন্দোলনের টাকা আসে কোথা থেকে ইত্যাদি প্রশ্ন করে পুলিশ। সবচেয়ে বড় কষ্টকর হলো, কোর্টে আনা-নেওয়ার সময় হ্যান্ডকাফ ও ডান্ডাবেড়ি পরানো হতো। কাউকে কাউকে রশি দিয়েও বাঁধা হতো।’
কারাগারেও তাদের প্রতি আইনবহির্ভূতভাবে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। হেফাজতের এই নেতা বলেন, ‘কারাগারে অন্য আসামিরা নিজের রুম ছাড়াও সর্বত্র ঘোরাফেরা করতে পারলেও আমাদের একটা রুমে ২৪ ঘণ্টা আটকে রাখা হতো। স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। প্রথম চার-পাঁচ মাস পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম।’