ফারুক ওয়াসিফ: বিশ শতকের পরাধীন ভারতে ‘দেশ’ বিষয়ে তিনটা ইউটোপিয়া হাজির হয়েছিল: হিন্দুস্তান, পাকিস্তান ও নারীস্তান। তৃতীয়টাকে সহজেই কল্পনা বলে চেনা যায়, কিন্তু হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানও কল্পরাষ্ট্র, যা আদতে বাস্তবায়িত হয়নি। তাঁর নারীস্তান, হিন্দুস্তান ও আরো পরের পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী। অন্তত তত্ত্ব ও সিহিত্যে। নারীস্থানের সুলতানা পুরুষালী জাতীয়তাবাদের প্রতিনায়িকা। সুলতানা তো জাতীয়তাবাদের দেমাগকে পাত্তাই দেয় না। পুরুষবাদী জাতীয়তাবাদে ডিকলোনাইজেশন নাই, রোকেয়ার জাতীয়তাবাদে আছে।
বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ এবং বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন বাংলাসাহিত্যের শক্তিশালী দুটি ইউটোপিয়া। পরেরটিকে আগেরটির অ্যান্টিথিসিস ধরেও মজার জিনিস চোখে পড়ে। বঙ্কিম যেখানে হিন্দু জাগরণের তেজষ্ক্রিয় প্রেরণা ছড়ান, ব্রিটিশ শাসনকে আড়াল করে মুসলমান নিধনেই সমাধান দেখান, এবং এই দেশোদ্ধার ব্রত আর্যগর্বে হিন্দু ভাতৃসংঘের মহিমা কীর্তন করে; রোকেয়া সেখানে বিদেশি আগ্রাসন এবং স্বদেশীয় পুরুষপ্রাধান্য খর্ব করার মাধ্যমেই জাতীয় মুক্তির দিশা (ভিশন) রচনা করেন। আনন্দমঠের সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃসংঘের বিপরীতে তিনি আনেন সেক্যুলার ভগ্নিসংহতির শক্তিকে। বাহুবলের তুলনায় শ্রেষ্ঠ করেন বুদ্ধিবৃত্তিকে।
জাতীয় মুক্তি ছাড়া যখন আর কোনো মুক্তির চিন্তাই তৈরি হয়নি, তখন নারীদের ভ্যানগার্ড করার মাধ্যমে, ফ্রাঞ্জ ফ্যানোকথিত বিপ্লবী ওলট-পালট ঘটিয়ে পুরুষালী জাতীয়তাবাদের পুরুষশ্রেষ্ঠতা নাকচ করেন।
জাতি একটা ইমাজিনড কমিউনিটি, এ তো বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসরন বলে গেছেন। রোকেয়াও সেভাবে নারীদের একটা কল্পিত জাতি ভাবেন। ন্যাশন নয়, বরং বৃহত্তর সম্প্রদায়। এই তিন জাতীয়তাবাদের চিন্তার কেন্দ্রে ছিল হোম বা দেশ। চোখের কাছে এনে দেখলে তা আসলে ‘ঘর’—গৃহ। দেশভাগের গৃহদাহ, শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ, রবীন্দ্রনাথের গৃহদাহ (ঘরে বাইরে) দেখলে এটা মালুম হবার কথা। এই ঘর ভার্জিনিয়া উলফের ‘আ রুম অব ওয়ানস ওউন না’, এ হলো জাতীয় ঠিকানা,নোঙর, পয়েন্ট অব রেফারেন্স।
ঊনিশ শতকে গৃহ বা হোম রাজনীতির অন্তঃপুর হয়ে ছিল না শুধু, গৃহই ছিল জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের প্রথম পট। অন্তঃপুরের নারীকে বিদেশি শাসকের দৃষ্টি, সাংস্কৃতিক প্রভাব ও হস্তের বাইরে রাখ। যেহেতু তারা জাতির পবিত্র জমি, সেখানে ভিন্ন বীজ পড়তে পারবে না। তাই তুমি অবরোধবাসিনী, দূর দ্বীপবাসিনী।
তখন অন্তঃপুর বাসিনীদের অন্তঃপুরে রাখাই তো জাতীয় চ্যালেঞ্জ। রোকেয়ার কাজ তাই হয়ে দাঁড়ালো অন্তঃপুরকেই অবরূদ্ধ ‘জাতি’ হিসেবে দেখানো এবং সেই জাতিকে ঘরে ও বাইরে দুখানেই স্বাধীন দাবি করা। অবরোধভাঙ্গা সেই মুক্ত অন্তঃপুরই রোকেয়ার নারীস্থান, তার গৃহ বা হোম। ওমেনসল্যান্ডই তাঁর হোমল্যান্ড।
সে যুগের জাতীয়তাবাদী চিন্তায় অন্তঃপুর বড় জায়গয় ছিল। ততটা শিক্ষা ও আধুনিকতা অন্তঃপুরবাসিনীদের দরকার যতটা নবভারতীয় সনাতন কি আধুনিক পুরুষের উপযুক্তা গৃহিনীর দরকার। রোকেয়া নারীর জন্য বাঁধভাঙ্গা স্বাধীনতার লক্ষ করেন (নারীস্থানে) স্বাধীন সমৃদ্ধ দেশগঠনের সক্ষমতা অর্জন। তিনি নারীদের দেখতে চান নাগরিক কর্তাসত্তা হিসেবে। সেসময়ের সকল রংয়ের জাতীয়তাবাদ ও সংস্কার চিন্তা নারীকে নাগরিক হলেও কর্তাসত্তা হিসেবে অর্থাৎ নগরে নিজস্বভাবে চলার। অধিকারী হিসেবে মানা অনেকের কাছেই অসম্ভব ছিল। সুলতানা’স ড্রিমের নায়িকারা নিজেরাই মানবতা।
বঙ্গভঙ্গের বছর (১৯০৫) যখন ভদ্রলোক সমাজের সদর মোকামে জাতীয়তাবাদী আবেগ জাতীয় কল্পনা রচনা করছে (বন্দে মাতরম থেকে আমার সোনার বাংলা ইত্যাদি), যে কল্পনায় দেশকে নিষ্ক্রিয় অরক্ষিত মাতৃরূপা নারী বলে ভাবা হচ্ছে, সেসময়ে সক্রিয় ভিশনারি নারীর আদল হাজির করা পুরুষ জাতীয়তাবাদের সমালোচনা। রোকেয়া পুরুষালী রক্ষণশীল মধ্যবিত্তের ইউটোপিয়াকে নারীর ডিসটোপিয়া বলে ভাবেন, উল্টোদিকে রোকেয়ার সুলতানাস ড্রিম হলো পুরুষালী জাতীয়তাবাদের ডিসটোপিয়া।
বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ (ঘরে বাইরে) পর্যন্ত যেখানে গৃহকেই নারীর যথার্থ স্থান গণ্য করেন, সেখানে রোকেয়া বাহিরকেই গৃহ করে তোলার রাজনীতির সূচনা করেন। উপনিবেশবাদ, রক্ষণশীল ধর্মতন্ত্র ও পুরুষালী জাতীয়তাবাদের সমালোচনা হিসেবে রোকেয়াকে অস্বীকার করা আজো কঠিন। রোকেয়ার রাজনৈতিক প্রকল্পে নারীর অধস্তনতাকে দুই তরফা উপনিবেশিত হওয়ার ফল হিসেবে দেখে থাকে। একটি হলো জাতীয় পরাধীনতা অন্যটি স্বজাতির পুরুষের অধীনতা—পিতৃতন্ত্রের জোড়বাহু শেকল।
বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ দুজনই কোনো একটা মৌলিক পরিবর্তনের প্রত্যাশী। কিন্তু ইতিহাসের ধারা, বাস্তবতার যুক্তি এবং কায়েমি ন্যায়বোধ তাঁদের কাঙ্খিত বিপ্লবকে অনুমোদন করবে না বলে তাঁরা ইতিহাসের বাইরে, বাস্তবতার ঊর্ধ্বে তাঁদের প্রকল্পকে নিয়ে যান (গোরা ও আনন্দমঠে)। স্বপ্নকে তিনি বাস্তবের পিঠে ফেলে বাস্তবের কারাগার ভাঙ্গার যে প্রকল্প হাজির করেছেন, তার সাহিত্যিক চমৎকারীত্বও কম না।
রোকেয়ার রাজনৈতিক প্রকল্পে নারীর অধস্তনতাকে দুই তরফা উপনিবেশিত হওয়ার ফল হিসেবে গণ্য করে। একটি হলো জাতীয় পরাধীনতা অন্যটি হলো স্বজাতির পুরুষের অধীনতা এবং দুটোই পিতৃতন্ত্রের জোড়বাহু হিসেবে তাঁর কাছে এক মহা আপদ হিসেবে ধরা পড়ে। মুক্তিফল আখ্যায়িকার মধ্যে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের তিনটি ধারাকে রূপক করে সমালোচনা করা হয়েছে। (ফ্রান্য ফানো যেভাবে কলোনিয়াল বুদ্ধিজীবীদের তিনটি দশা চিহ্নিত করেন)।
সত্তর দশকীয় মার্কিন নারীবাদী স্লোগান পারসোনাল ইজ পলিটিক্যাল আবির্ভাবের অনেক আগেই রোকেয়া একই ধ্বনি তুলেছেন এমন নয়। প্রথম যুগের ইউরোপীয় নারীবাদের দেখানো পথে (এ রুম অব ওয়ানস ওউন বা দ্য ভিন্ডিকেশন অফ ওম্যানস রাইট) নারীকে পুরুষের মতোই স্বাধীন ব্যক্তি হয়ে ওঠার নিদানে ভরসা করেননি। বরং তিনি নারী মুক্তির প্রশ্নকে সামাজিক ও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে দেখেছেন। সুলতানার স্বপ্নের ভগ্নি সারা তাই ‘আমি’ বচনে জগত দেখে না, দেখে ‘আমরা’র মধ্যে বিরাজিত হিসেবে। পশ্চিমা নারীবাদ যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, রোকেয়ার নারীবাদ সেখানে কমিউনিটারিয়ান। এমনকি সুলতানা’র ড্রিমে নারীস্তানে যখন আগ্রাসন হয়, তখন রানী তাঁর নাগরিকদের সঙ্গে মরতে তৈরি হয়ে যান। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ আইডিয়া হিসেবে দারুণ। কিন্তু সাহিত্য নয়। সাহিত্য হয়ে ওঠার ক্ষমতা ভিন্ন জিনিস। সাহিত্যর কল্পনা এর মধ্যে দেখা যায়, কিন্তু সাহিত্যের চেয়েও বড় যেখানে ‘সুলতানাস ড্রিম’ তা হলো এটা যেন মুক্তির ইশতেহার।
লেখক : কবি , প্রাবন্ধিক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট