সমতট ডেস্ক: বর্তমান বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতকে লেখক ও গবেষক শাহীদ কামরুল ‘হরিণের আস্তাবলে বাঘের ছানার জন্ম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আইন জালুতের যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট টেনে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে ইসরায়েলে আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইরান পশ্চিমাদের তৈরি “অজেয় ইসরায়েল” বয়ানকে চুরমার করে দিয়েছে। এটি শুধু ইসরায়েলের শ্রেষ্ঠত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, বরং মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের মনে দশকের পর দশক ধরে সঞ্চিত ভীতিকেও চিরতরে ধ্বংস করে দিয়েছে বলে তার অভিমত।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ইরানের প্রাচীন ইতিহাসে মেদিস, আকামেনিড, সেলুসিড, পার্থিয়ান ও সাসানীয় সাম্রাজ্যের গৌরবময় অধ্যায়গুলো উল্লেখ করে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে এই জাতি যুগে যুগে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন এবং ইসলামিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ভাষা টিকিয়ে রেখেছে। পারস্যের বিখ্যাত পণ্ডিতদের বিজ্ঞান, সাহিত্য ও দর্শনে অবদান এবং চেঙ্গিস খান ও তৈমুরের আক্রমণের পর সাফাভি, আফশারদ, জান্দ, কাজার ও পাহলভি রাজবংশের শাসনামল তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে রেজা শাহ পাহলভির আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টা এবং ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব পর্যন্ত ইরানের ঐতিহাসিক গতিপথ বর্ণনা করা হয়েছে। লেখকের মতে, একটি জাতির ইতিহাস থেকেই তাদের সংগ্রাম ও স্বাধীনচেতা মনোভাব গড়ে ওঠে।
সাম্প্রতিক সংঘাতের নেপথ্য কারণ: চলতি বছরের শুরুতে হিজবুল্লাহ সৈন্যদের পকেটে থাকা পেজার ডিভাইস ব্যবহার করে ইসরায়েলের হামলার ঘটনা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের পক্ষ থেকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টকে উপহার হিসেবে পেজার পাঠানোর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক চুল্লিতে আক্রমণের সুযোগ খুঁজলেও আমেরিকার সিআইএ’র মতে, ইরানে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র নেই। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করতে আগ্রহী ছিল, তবে ইরানের আয়াতুল্লাহ খামেনি তা বাতিল করে দেন। এই সুযোগে ইসরায়েল ইরানের চুল্লিতে আক্রমণ করে, যেখানে ইসরায়েলের নিজস্ব গোয়েন্দারা ভেতরে প্রবেশ করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
প্রোপাগান্ডার ভূমিকা ও যুদ্ধের বাস্তবতা: লেখক এই যুদ্ধে প্রোপাগান্ডার ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, আধুনিক যুদ্ধে প্রোপাগান্ডা একটি শক্তিশালী অস্ত্র, যেখানে আধা-সত্য তথ্য ছড়িয়ে জনমতকে প্রভাবিত করা হয়। চলমান ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধেও ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চলছে। যদিও যুদ্ধে ইরানের ক্ষতি অনেক হয়েছে (যেমন: শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী ও ২০ জন সেনা কমান্ডারের মৃত্যু), কিন্তু প্রথম দিনের বিশাল ক্ষতির পরও ইরানের প্রত্যাঘাত ইসরায়েলিদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। নেতানিয়াহু ভেবেছিলেন ইরানি জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে, কিন্তু বাস্তবে তারা সরকারের পক্ষেই রাস্তায় নেমে এসেছে। লেখক তার ইরানি বন্ধুদের বরাত দিয়ে বলেছেন, ১৯৯০ সালের যুদ্ধের পর ইরান এতটা ঐক্যবদ্ধ আর কখনো হয়নি।
চমস্কি ও হারম্যানের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ তত্ত্বের প্রয়োগ: চমস্কি ও হারম্যানের ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ তত্ত্বের উদাহরণ টেনে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে গণমাধ্যম ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খবর প্রচার করে এবং দর্শকদের রাষ্ট্র-সমর্থিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহায়তা করে। যখন কেউ ইরান বা হামাসের পক্ষ নেয়, পশ্চিমা মিডিয়া দ্রুত তাকে হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করে, যা ইসরায়েলি বয়ানকেই মূলধারার সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি ও বিশ্ব অর্থনীতির ওপর প্রভাব: বর্তমানে ইরানের পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংসের পরিকল্পনা চলছে। লেখক উল্লেখ করেছেন, ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের একটি আমেরিকান কনভেনশনাল অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে, যা শুধু আমেরিকান বি-২ বিমান দিয়েই বহন করা সম্ভব। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আমেরিকাকে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে না দেওয়ায় এটি কঠিন কাজ হবে। বিকল্প হিসেবে ইউরোপ থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বা ফাইটার জেট দিয়ে আক্রমণের কথা ভাবা হলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য সরাসরি যুদ্ধে যাওয়া কঠিন হবে, কারণ তার ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন (মাগা)’ সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব রয়েছে। এটি মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ‘ওয়ার অফ অ্যাট্রিশন’ বা অস্ত্রের ভাণ্ডারের পরীক্ষা চলছে। লেখক মনে করেন, ইসরায়েল গাজায় যা করতে পেরেছে, তা ইরানে সম্ভব নয়, কারণ ইরানের বিশাল ভূখণ্ড একটি প্রাকৃতিক দুর্গ। তিনি সমরবিদদের বরাত দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ইরান, রাশিয়া ও সুইজারল্যান্ড – এই পাঁচটি দেশ যুদ্ধ করে হারানো অত্যন্ত কঠিন।
যদি আমেরিকা আলোচনার মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে আসতে না পারে এবং যুদ্ধে ইরানকে হারাতে না পারে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার বৈশ্বিক প্রভাব কমতে পারে এবং রাশিয়া, চীন ও ইরানের প্রভাব বাড়বে। এতে ইরান আরও শক্তিশালী হবে এবং সুন্নি দেশগুলোতেও ইরানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে বলে লেখক মনে করেন।