সমতট ডেক্স : স্থানীয় উন্নয়নে আগামী দিনে সংসদ সদস্যদের (এমপি) খবরদারি থাকছে না। এজন্য সংবিধানের ৫৯ নম্বর অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনা হচ্ছে। এমপিদের নির্বাচনি এলাকায় নাক গলানো বা হস্তক্ষেপে ওই ধারাটি সুরক্ষা কবচ বলে মনে করছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। তাই কমিশন এমপিদের হস্তক্ষেপ বন্ধসহ আরো নানা ধরনের সুপারিশ করবে।
সুপারিশের মধ্যে থাকবে জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অভিন্ন আচরণবিধি প্রণয়ন করা, দলনিরপেক্ষ নির্বাচন; অর্থাৎ প্রণীত আইনে সংশোধনী এনে দলীয় প্রতীক বিলুপ্ত করা, জনগণের ভোটে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া, সরকারের জন্য বোঝা—এমন শতাধিক পৌরসভা বিলুপ্ত করা; নারী সদস্যদের জন্য সরাসরি ভোট আয়োজনে ঘূর্ণায়ন পদ্ধতিতে (নারী বনাম নারী) ওয়ার্ডভিত্তিক আসন সংরক্ষিত রাখা, চতুর্থ দফায় পুরুষের সঙ্গে সমানতালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা; অর্থাৎ নারী আসন সংরক্ষিত না রাখা, নারী নির্যাতনকারী, ধর্ষক ও মাদক কারবারি ভোটে অযোগ্য হবেন।
খবর সংস্কার কমিশনের একাধিক সদস্যের সূত্র জানায়, একজন প্রার্থী হলফনামায় অঙ্গীকার করবেন, তিনি যা যা তথ্য দিয়েছেন সব সত্য। এরপর তিনি তথ্য গোপন করে বিজয়ী হলেও সংক্ষুব্ধ কেউ ইসির নজরে আনলে প্রমাণসাপেক্ষে প্রার্থিতা হারাবেন এবং স্থানীয় স্তরের (জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা) নির্বাচনগুলো কাঠামোর মধ্যে আনতে স্বতন্ত্র কমিশন হবে। তবে সেটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), নাকি সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), নাকি তথ্য কমিশনের আদলে হবে সেই পদ্ধতি খুঁজছে সংস্কার কমিশন। মেয়াদোত্তীর্ণ হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ ছাড়াই ইসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারবেন। এ ছাড়া জাতীয় সরকারের মেয়াদ যা হবে স্থানীয় সরকারের মেয়াদও একই থাকবে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ আমার দেশকে বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো রাষ্ট্রের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকারের পরামর্শে এগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আমরা সুনির্দিষ্ট করে একটি কমিশনের অধীনে করার সুপারিশ করতে পারি সরকারের কাছে। এলাকার উন্নয়নে এমপিদের হস্তক্ষেপ বন্ধেও করা হতে পারে সুপারিশ। এসব আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির আগে সবকিছু সমন্বয় করে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ আরো বলেন, জাতীয় সরকারের মেয়াদ যা হবে, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অনুরূপ মেয়াদ হবে—এমন সামঞ্জস্য রেখে সুপারিশ করার চিন্তা করছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য আমার দেশকে জানান, এমপিরা আইনপ্রণেতা। তাদের সব কার্যক্রম হবে সংসদ ঘিরে, আইন প্রণয়নকেন্দ্রিক এবং সেটা নির্দিষ্ট এলাকার জন্য নয়, বরং সার্বিক জনগণের কল্যাণে। তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদে এমপিরা উপদেষ্টা হয়ে স্থানীয় উন্নয়নে নানাভাবে নাক গলান, সুপারিশে সেই পথও বন্ধ হবে। এমপিদের জন্য নির্দিষ্ট থোক বরাদ্দ দেওয়ার বিধান আছে, এটা বেআইনি। এ বরাদ্দের অর্থে টেস্ট রিলিফ (টিআর), কাজের বিনিময়ে কর্মসূচি প্রকল্প (কাবিখা), কাবিটা, দুস্থ ভাতা ও বয়স্ক ভাতাসহ নানা ভাতা প্রদানে দিকনির্দেশনা দেন।
এর ফলে এমপিরা আইনপ্রণেতা না হয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাই আগামী দিনে তাদের আইন প্রণয়নে মনোনিবেশ করার সুযোগ রাখতে স্থানীয় উন্নয়নে থোক বরাদ্দ বাতিলের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সংসদের মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখতে সংবিধানের ৫৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করবে কমিশন।
এর বাইরে সংবিধান কমিটিও তাদের পাঠানো প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। কারণ নির্বাচনি এলাকার উন্নয়নে এমপিদের খরবদারি বা হস্তক্ষেপ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে এমপিদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধে আইন মন্ত্রণালয়কে আইনগত নির্দেশনা জারির জন্য সুপারিশ করবে বলেও জানান তিনি।
অন্য একজন সদস্য আমার দেশকে বলেন, সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হবে। নারীদের নির্বাচনমুখী ও সক্ষম হওয়ার সুযোগ রাখতে ঘূর্ণায়নমান পদ্ধতিতে তিন মেয়াদ পর্যন্ত আসন সংরক্ষিত থাকবে। প্রথমবার নির্বাচনে ১ থেকে ৩টি ওয়ার্ড হলে পরবর্তী নির্বাচনে ৪ থেকে ৬ এবং তৃতীয়বার ৭ থেকে ৯ ওয়ার্ড শুধু নারী বনাম নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। চতুর্থবার উঠে যাবে সংরক্ষিত ওয়ার্ড এবং নারী-পুরুষ উভয়ই প্রার্থী হবেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ইসির কোনো ক্ষমতা নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে কমিশন এ নির্বাচনগুলো করে থাকে। আগামী দিনে স্থানীয় নির্বাচন করার জন্য ইসিতে ক্ষমতা অর্পণ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ করা হবে। একই সঙ্গে এ কার্যক্রমটি যাতে শক্তিশালী হয়, সেজন্য স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন থেকে ইসি ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশনকেও প্রস্তাব রেখেছিল।
এ প্রসঙ্গে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটি ইসি ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশনও সুপারিশ করেছে, যা ইতিবাচক।’
এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করে থাকে ইউজিসি। স্বতন্ত্র প্রক্রিয়ায় ইউজিসি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করে না। আগামী স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর জন্য স্বতন্ত্র কমিশন করার সুপারিশ করবে গঠিত সংস্কার কমিশন। এ কমিশন স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও জবাবদিহির মধ্যে রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছে এ কমিশন।
এ ছাড়া আগামী দিনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের যে কোনো স্তরে প্রার্থী হলে তার বিরুদ্ধে নারী ধর্ষণ, নারীর শ্লীলতাহানি কিংবা মাদক কারবারে জড়িত থাকলে নির্বাচনের পরও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অভিযোগ দায়ের করলে তার পদে থাকা অযোগ্য হবেনÑএমন কঠিন বিধান যুক্ত করে সুপারিশ করার চিন্তা করছে কমিশন।
এ ছাড়া দেশত্যাগী হাসিনা সরকারের সময়ে তৃণমূলের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক দিয়ে গ্রামীণ সম্প্রীতি নষ্ট করা হয়। কমিশনের একগুচ্ছ সুপারিশের মধ্যে এটি থাকছে প্রথম দিকে। আগামী দিনে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন।