সমতট ডেক্স : ‘সরকার গেছে পাগল হইয়া, তারা একটা রায় চায়’- আমার দেশে ২০১২ সালে প্রকাশিত সাড়া জাগানো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘স্কাইপ কেলেঙ্কারির’ প্রথম শিরোনাম ছিল এটা।
সে স্কাইপ কেলেঙ্কারিতে আলোচনায় উঠে আসা ভিলেনরা এখন কে, কোথায়? এ নিয়ে অনুসন্ধানে তাদের বর্তমান অবস্থা ও জুডিশিয়াল কিলিংয়ে ভূমিকা সম্পর্কে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নামে বিচারিত হত্যা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছিল। তখনই আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় স্কাইপ স্ক্যান্ডাল। এটি ছিল বিচারের নামে সেই সময় চলমান নাটক নিয়ে নিজামুল হক নাসিম ও আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ কথোপকথন।
এ কথোপকথনে উঠে এসেছিল জুডিশিয়াল মার্ডারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পুরো চিত্র। কথোপকথনে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিলেনরা ছিলেন, ফ্যাসিবাদের প্রথম আমলের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, নিজামুল হক নাসিম, এটিএম ফজলে কবির, জাহাঙ্গীর হোসেন, ওবায়দুল হাসান ও ইনায়েতুর রহিম। সেই স্কাইপ কেলেঙ্কারির হোতারা এখন কোথায়?
প্রসিকিউশন টিমে ছিলেন গোলাম আরিফ টিপু, রানা দাশগুপ্ত, জিয়াদ আল মালুম ও অন্যান্য আওয়ামী আইনজীবী। সরকারি লোকজনের বাইরে আহমেদ জিয়াউদ্দিন বেলজিয়াম থেকে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নাসিমকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায় লিখে দিতেন। স্কাইপ কথোপকথনের বিভিন্ন পর্যায়ে এই চরিত্রগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
ব্যারিস্টার শফিক ছিলেন সার্বিক তত্ত্বাবধানে
আইসিটির মাধ্যমে জুডিশিয়াল মার্ডার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ। নিজামুল হক নাসিম ট্রাইব্যুনালে বাস্তবায়ন করতেন তার নির্দেশ। ড. আহমদ জিয়াউদ্দিন বেলজিয়াম থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে পরামর্শ দিতেন ব্যারিস্টার শফিক আহমদকে। এ ছাড়া শফিক আহমদ, আহমদ জিয়াউদ্দিন, নিজামুল হক নাসিম ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহার মধ্যে ছিল নিবিড় যোগাযোগ। তারা একে অপরের সঙ্গে সলাপরামর্শ করতেন নিয়মিত।
প্রথম ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ কে এম জহিরের পদত্যাগ, নিজামুল হক নাসিমকে পদোন্নতি দেওয়া প্রসঙ্গে স্কাইপ আলোচনায় তাদের পরস্পরের এই যোগাযোগ এবং পরামর্শের বিষয়টি দিবালোকের মতোই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। একেএম জহিরের পদত্যাগ প্রসঙ্গটি উঠে এসেছিল ২০১২ সালের ২৭ আগস্টের কথোপকথনে। সেদিনের আলোচনায় আরও রয়েছে, জহিরুল হক পদত্যাগের পর বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে কী শর্তে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। নিজামুল হক সেদিন আহমদ জিয়াউদ্দিনকে জানান, জহিরুল হক হঠাৎ আইন মন্ত্রণালয়ে যান। দিনের প্রথমার্ধ শেষে দুপুরের বিরতিতে তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে দিনের দ্বিতীয়ার্ধে বিচারকের আসনে বসতে অপারগতা প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে জানান, আইন মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর তার কাছ থেকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর রেখে দিয়েছেন আইনমন্ত্রী শফিক আহমদ।
উল্লেখ্য, আল্লামা সাঈদীর মামলা চলাকালীন সাক্ষীদের এনে সেইফ হাউসে রেখে প্রশিক্ষণের তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট করেছিল আমার দেশ। এ রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটির সাক্ষীর বয়ান নিয়ে রিভিউ পিটিশন করা হয়েছিল আল্লামা সাঈদীর পক্ষ থেকে। এই রিভিউ পিটিশনের শুনানি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের সঙ্গে একমত পোষণ না করায় তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমদ তাকে ডেকে নিয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর রেখে বিদায় দেন।
এ কে এম জহিরের পদত্যাগের পর দ্রুততার সঙ্গে জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালে। জাহাঙ্গীর হোসেন ছিলেন তখন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই প্রথম ধাপে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল হাইকোর্ট বিভাগে। কথোপকথনে উঠে আসে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম তার বন্ধুকে জানিয়েছিলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন আইনমন্ত্রীর চয়েজ নয়। তিনি জানিয়েছিলেন- এটা ‘কামরুল-টামরুলের’ চয়েজ। আরও জানিয়েছিলেন এতে কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ, তাকে নিয়োগের সময় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যান যেভাবে বলে তার সঙ্গে শুধু ইয়েস বলতে। নাসিমের একথা থেকেই স্পষ্ট ব্যারিস্টার শফিকের বার্তা অনুযায়ী পারফর্ম করতেন নাসিম। আর নাসিমের কথায় শুধু ইয়েস বলতে হবে, এই শর্তে জাহাঙ্গীরকে নিয়োগ দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিনাভোটের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা তাকে আর মন্ত্রী বানাননি। মন্ত্রিত্ব থেকে বিদায় নিয়ে আইন পেশায় ফিরলেও শফিক আহমদকে সামনের সারিতে আগের মতো আর দেখা যায়নি। তিনি এখন বাড়িতেই সময় কাটান।
নাটের গুরু এসকে সিনহা
স্কাইপ কথোপকথনে উঠে আসা চরিত্রে আরেক খলনায়ক সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা। তিনি ছিলেন অন্যতম নাটের গুরু। স্কাইপ আলোচনায় নিজামুল হক নাসিম তার বন্ধু জিয়াউদ্দিনকে জানিয়েছিলেন, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ৩টাকে দিয়ে দেন। তারপর আপিল বিভাগে নেওয়া হবে। জবাবে নাসিম বলেছিলেন, যা করার করেন, আগে প্রমোশনটা দেন| এস কে সিনহার কথার অর্থ ছিল, ৩টা ফাঁসির রায় দিলে তাকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হবে। এই ৩টার মধ্যে নাম উল্লেখ করেছিলেন- আল্লামা সাঈদী, আবদুল কাদের মোল্লা ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তাদের টার্গেট অনুযায়ী এই ৩টা বিচার রায়ের দিকে এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল দ্রুততার সঙ্গে।
এসকে সিনহা পরে আমেরিকা চলে যাওয়ার পর আত্মজীবনী লেখেন। ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম’ নামে লিখিত বইয়ে সুরেন্দ্র কুমার ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। এ আলোচনায় তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, ট্রাইব্যুনাল গঠন ও বিচারক নিয়োগ থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে তার সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা। দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল কীভাবে গঠন করা হয়েছিল, ওবায়দুল হাসান শাহিনকে কেন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়েছিল সেটাও উল্লেখ করেছেন এসকে সিনহা।
তার বর্ণনা অনুযায়ী দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনে শেখ হাসিনার কিছুটা অনীহা ছিল। ব্যারিস্টার শফিক আহমদ এ বিষয়ে শেখ হাসিনাকে রাজি করাতে পারেননি। পরে সুরেন্দ্র কুমারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। পরামর্শ মোতাবেক দেশের প্রধান বিচারপতি গোপনে দেখা করেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। আলাপ করেন দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন নিয়ে। তখন শেখ হাসিনাকে বুঝিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচারের চেয়েও ট্রাইব্যুনালে বিচার সহজ হবে। কারণ, এখানে সাক্ষী বানানো যাবে বই পুস্তক ও পেপার পত্রিকা দিয়ে। যেটি শেখ মুজিবুর রহমানের মামলায় সম্ভব ছিল না। এসব বুঝিয়ে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনে শেখ হাসিনাকে রাজি করিয়েছিলেন এসকে সিনহা।
এছাড়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুল হাসান শাহিন ও ইনায়েতুর রহিমকে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিয়োগের পছন্দের প্রসঙ্গটিও উল্লেখ করেছেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
এসকে সিনহা আলোচনায় প্রথম ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়ে উল্লেখ করেন, প্রথম ট্রাইব্যুনাল গঠনের সময় রানা দাশগুপ্তকে চট্টগ্রাম থেকে আনা হয়েছিল বিচারক বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। শেষ পর্যন্ত বিচারক বানাতে না পেরে তাকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এই সুরেন্দ্র কুমারই আপিল বিভাগে প্রতিটি মামলার শুনানি অংশ নিয়ে ফাঁসি কার্যকরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে শেষ বেলায় নিজেদের মধ্যে দ্ব›দ্বন্দ্বে শেখ হাসিনা ডিজিএফআইকে দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেন তাকে। বর্তমানে লোকচক্ষুর অন্তরালে কানাডায় আছেন জুডিশিয়াল মার্ডারের অন্যতম কারিগর এস কে সিনহা।
নিজামুল হক নাসিম
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন নিজামুল হক নাসিম। পরে ব্যারিস্টার শফিক আহমদ ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহাদের অতি বিশ্বস্ত নাসিমের কাঁধে অর্পিত হয়েছিল ফাঁসির রায় দেয়ার দায়িত্ব। আহমদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে কথোপকথনে উল্লেখ করা বক্তব্য অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ট্রাইব্যুনালে তিনি এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, আসামিপক্ষের কোনো যুক্তি, তথ্যউপাত্ত তার কাছে পাত্তা পেত না। ফাঁসির রায় দেওয়ার নির্ধারিত লক্ষ্যে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছিল টার্গেট করা মামলাগুলো।
২০১২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর স্কাইপ আলোচনায় নিজামুল হক নাসিম মামলাগুলো দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে তার সাজানো পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি তো কোনো অ্যাডজর্নমেন্ট দিই না।’ অর্থাৎ বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য তিনি কোনো মুলতবি আবেদন গ্রহণ করেন না। তিনি আরও উল্লেখ করেন- এমনভাবে সাজানো হয়েছে- হয় সাঈদী, না হলে গোলাম আযমের মামলা শুনানি করতেই হবে।’ অর্থাৎ এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে এই দুই মামলার যে কোনো একটা প্রতিদিন শুনানি করা যায়।
পূর্বপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখায় নিজামুল হক নাসিম ফ্যাসিবাদের জামানায় পুরস্কৃত হয়েছেন দফায় দফায়। স্কাইপ কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পরও তাকে আপিল বিভাগে প্রমোশনই শুধু নয়, অবসরে যাওয়ার পর প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান বানানো হয়েছিল। জুডিশিয়াল মার্ডারে নেতৃত্ব দেওয়া এবং স্কাইপ কেলেঙ্কারির প্রধান কুশীলব বিচারপতি নাসিম অজ্ঞাত কারণে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। আমার দেশ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সাংবাদিকের সঙ্গে এখন কোনো কথা বলেন না।
আহমদ জিয়াউদ্দিন
ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামে তার অবস্থান। সেখান থেকেই শেখ হাসিনার জামানায় গঠিত ট্রাইব্যুনালের কলকাঠি নাড়তেন। নিজামুল হক নাসিমের সঙ্গে স্কাইপ কথোপকথনে তাকে বলতে শোনায় যায় বিভিন্ন বিষয়ে ব্যারিস্টার শফিক আহমদের সঙ্গে কথা বলে পরামর্শ দিয়েছেন। এই পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে কি না, সেটার ফিডব্যাক নিতেন নিজামুল হক নাসিম থেকে। তারা নিজেরাই ট্রাইব্যুনালকে নাটক মনে করতেন। ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর স্কাইপ কথোপকথনে ড. আহমদ জিয়াউদ্দিন নিজেই নাসিমকে প্রশ্ন করেছিলেন, আজ নাটক কেমন হলো? জবাবে নাসিম বলেছিলেন-‘নাটক ভালোই হচ্ছে’।
প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম নাকি অযথা লাফিয়ে উঠতেন। সেজন্য আদালতের কার্যক্রম শেষে একদিন তাকে রুমে ডেকে আনা হয়েছিল। তখন জিয়াদ আল মালুমকে বলা হয়েছিল কোর্টে এত লাফালাফি করেন কেন। জবাবে নাসিমকে উদ্দেশ করে তিনি বলে বলেছিলেন- ‘আমি দাঁড়াইয়া যামু, আপনি আমারে বসাইয়া দেবেন। লোকে দেখুক আমাদের মধ্যে কোনো খাতির নাই।’ আহমদ জিয়াউদ্দিনের মামলাগুলোর রায়ের খসরা বেলজিয়াম থেকে লিখে দিতেন। এছাড়া মামলা চলাকালীন চার্জ গঠনের আদেশ, বিভিন্ন বিষয়ে আসামিপক্ষে রিভিশন, আবেদনের প্রেক্ষিতে কি আদেশ দিতে হবে, সবই লিখে পাঠাতেন আহমদ জিয়াউদ্দিন। আল্লামা সাঈদীর মামলার শেষ পর্যায়ে রায়ের খসড়াও লিখে পাঠিয়েছিলেন তিনি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এই ব্যক্তি এখনও ইউরোপেই অবস্থান করছেন।
জিয়াদ আল মালুম
এক সময়ের বাম রাজনীতি করা জিয়াদ আল মামুন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ছিলেন। তাকে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ট্রাইব্যুনালে। বিচারের নামে প্রহসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল তার ওপর। স্কাইপ কথোপকথনে আহমদ জিয়াউদ্দিন একাধিক প্রসঙ্গে জিয়াদ আল মালুমের কথা উল্লেখ করেছেন।
নিচের কথোপকথনটি লক্ষ করলেই বোঝা যায়, শফিক আহমদ, জিয়াদ আল মালুম, আহমদ জিয়াউদ্দিন ও নিজামুল হক নাসিম কতটা ঘনিষ্ঠভাবে ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আলোচনা করতেন।
‘…আহমদ জিয়াউদ্দিন : এ্যাঁ…, খবর তো আমরা কালকে নিজেরা কথা বলছি। সো… একটা চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে এগুলোর। আপনার সঙ্গে কালকে যেটা কথা হইছে। কাল মালুম ভাইর সঙ্গে কথা হয় নাই। কাজেই… আজকে ওই গোলাম আযমেরটা কতদূর আগাইছে?
নিজামুল হক নাসিম : গোলাম আযম ফার্স্ট হাফ হইছে। সেকেন্ড হাফে আবার সাঈদী ধরছিলাম। আগাচ্ছে আর কি। সাঈদীর তো ওই ডকুমেন্ট জমা হচ্ছে। ১৩ নম্বর সাক্ষী এখনও চলতেছে, চলবে…।
আহমদ জিয়াউদ্দিন: উনাদের কারো সঙ্গে কালকে কথা হয় নাই অবশ্য। কালকে বোধহয় ছুটির দিন ছিল দেইখ্যা উনারা ব্যস্ত ছিলেন বোধহয়, এইজন্য স্কাইপে আসতে পারে নাই।
নিজামুল হক নাসিম: আইজকে তো… আচ্ছা দেখা যাক, সাঈদী এবং গোলাম আযম কেসই তো আগাচ্ছি।
আহমদ জিয়াউদ্দিন: হ্যাঁ, ওই যে দুই নাম্বারের চক্করটা। এটা বোঝার জন্য আলোচনা কালকে রাত্রে হওয়ার কথা ছিল। আমি ধারণা করছিলাম হয়তোবা আজকে হবে। দেখা যাক, আমি মনে করি এইটা যে, দুই-তিনটা স্ট্র্যাটিজি হতে হবে। একটা হচ্ছে যে, একটা অলরেডি মেসেজ দেওয়া হইছে আর কি…। আইনমন্ত্রীকে দেওয়া হইছে। মানে দেওয়ার কথা আজকে মেসেজ পৌঁছানোর কথা আছে।
নিজামুল হক নাসিম: মেসেজ দেলে কি কাজ হইবে…, মেসেজে?
আহমদ জিয়াউদ্দিন: তা জানি না। কিন্তু এটা তো দিতে হবে। একদিক থেকে শুরু করতে হবে আরকি। এটা উনাকে মেসেজটা দেওয়া হচ্ছে যে একটা, ইয়েটা-ডিসিশনটা হবে দুই বছরে। মানে এটা একটা কাইন্ড অব পলিসি ডিসিশনের পার্ট হিসাবে হবে যে, কোন কেসটা আগে যাচ্ছে? অ্যাট লিস্ট প্রথম কেসটা। সেকেন্ড হচ্ছে যে, না হলে এটা একদম উপরে যেতে হবে। কারণ এখানে গুড রিজন আছে। যে সবচেয়ে বেশি যার দায়বদ্ধতা বেশি, যেটা সবচেয়ে বেশি সিগনিফিকেন্ট পলিটিক্যালি অ্যান্ড আদারওয়াইজ, সেগুলো তো আগে অ্যাডেস করতে হবে। বিশেষ করে রেসপনসিবিলিটির দিক থেকে। এটার রিয়েল এরিয়াতেও সিগনিফিকেন্ট এবং পলিটিক্যাল কনটেক্সটেও সিগনিফিকেন্ট। যে বড়গুলারে বাদ দিয়া ছোটগুলারে আগে নিয়া আসার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এটা প্রথম
থাইকা এই সমস্যাটা ছিল। কিন্তু এখন এইটা যে পর্যায়ে আসছে, এটাকে ওভারকাম করা যেতে পারে, যদি মন্ত্রীর একটা সিদ্ধান্ত হয়। এখন পর্যন্ত ১২টা সাক্ষী এই সেন্সে বাকি আছে। ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে জিয়াদ আল মামুন মারা গেছেন।
ওবায়দুল হাসান
৫ আগস্ট বিপ্লবের পর পদত্যাগ করে বিদায় নেওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতা প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে দেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব। তার প্রসঙ্গ নিজামুল হক নাসিম এবং আহমদ জিয়াউদ্দিনের স্কাইপ আলোচনায় ছিল। আহমদ জিয়াউদ্দিন ও নিজামুল হক নাসিমের কথোপকথন অনুযায়ী এক পর্যায়ে আইন মন্ত্রণালয় ওবায়দুল হাসানের সঙ্গেই বেশি যোগাযোগ রাখতো। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস থেকে ট্রাইব্যুনাল প্রসঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ে যত প্রশ্ন আসতো সব উত্তর লিখে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ওবায়দুল হাসানের।
এছাড়া ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালে আবদুল কাদের মোল্লার মামলা ধীরগতি করে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মামলার শুনানি হঠাৎ এগিয়ে আনা প্রসঙ্গেও আলোচনা করেন জিয়াউদ্দিন এবং নাসিম। শেখ হাসিনার নির্দেশ পালন করে ওবায়দুল হাসান একের পর এক পুরস্কৃত হয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে প্রথমে তাকে আপিল বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয় ৫০ জনকে ডিঙ্গিয়ে। অনায়াসে প্রধান বিচারপতিও হন। জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের কয়েক দিনের মধ্যেই তাকে ছাত্র বিক্ষোভের মুখে বিদায় নিতে হয়েছে। এখন গ্রেফতার আতঙ্কে সময় কাটছে শেখ হাসিনার বশংবদ এই প্রধান বিচারপতির।
ওবায়দুল হাসানে সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তার ঘনিষ্ঠজনরা জানান, তিনি আত্মগোপনে আছেন। কারো ফোন ধরেন না।
শাহিনুর ইসলাম
ট্রাইব্যুনালের প্রথম রেজিস্ট্রার ছিলেন শাহিনুর ইসলাম। তবে তার খায়েশ ছিল ট্রাইব্যুনালের বিচারক হওয়া। স্কাইপ কথোপকথনে আহমদ জিয়াউদ্দিন বলেছিলেন যে, শাহিনুর নাকি তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনেই পায়ে ধরে কদমবুসি করেছিলেন । শাহিনুরের সেই সালাম বিফল হয় নাই। তিনি ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে পুরস্কার স্বরূপ তাকে আপিল বিভাগে নেওয়া হয়। শাহিনুরকে আপিল বিভাগে পদোন্নতি দিতে ৫৭ জনকে সুপারসিড করা হয়েছিল। লোকটির শেষ পরিণতি হচ্ছে, বিপ্লবের পর তিনিও পদত্যাগ করে বিদায় নিয়েছেন। এখন জাজেস কমপ্লেক্সে একরকম বন্দি জীবনযাপন করছেন। কারো সঙ্গে দেখা করেন না তিনি। তার সঙ্গে আমার দেশ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ব্যক্তিগত সহকারী আবদুল আজিজ জানান, স্যার খুবই অসুস্থ। তিনি এখন কারো সঙ্গে দেখা করেন না।