দেশের বিভিন্ন এলাকায় ‘ওয়াই-ফাই গ্রাম’ গড়ে তুলেছেন মোবারক হোসেন। এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়েছে দেশে এক হাজারেরও বেশি গ্রাম। এই কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি সম্প্রতি। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০২৩’ পুরস্কারে (ব্যক্তি শ্রেণি) ভূষিত হয়েছেন তিনি। দেশের সব গ্রামে রাউটারের মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছাতে চান মোবারক হোসেন। এ জন্য দেশের সব গ্রাম নিয়ে একটি ডেটাবুক ও ম্যাপ তৈরি করেছেন দেশীয় ক্লাউড সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান প্লেক্সাস ক্লাউড’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোবারক হোসেন।
মোবারক হোসেন দেশে একটি ক্লাউড ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে চান। দেশীয় ক্লাউড (প্লেক্সাস ক্লাউড) দিয়ে সেবাদান করে তিনি দেশের টাকা দেশেই রাখতে চান। স্বপ্নবান এই কর্মবীরের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হিটলার এ. হালিম।
বাংলা ট্রিবিউন: প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত স্মার্ট বাংলাদেশ পুরস্কার-২০২৩ পেলেন। আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
মোবারক হোসেন: হঠাৎ করেই জানতে পারলাম যারা প্রযুক্তি নিয়ে সৃজনশীল কাজ করছে তাদের একটা পুরস্কার দেওয়া হবে। চিন্তা করলাম আমাদের এই প্রকল্পটা গ্রাম কেন্দ্রিক। আমরা নিজেরাই এটা ডেভেলপ করেছি। তখন এই প্রজেক্টটা নিয়েই আমি অনলাইনে আবেদন করি। আবেদন করার পর আমার কাছে ১০ মিনিটের একটা প্রেজেন্টেশন চাওয়া হয়। অনলাইনে আবেদন করার পর আমি যে এমন একটা ফিডব্যাক পাবো এটা আসলে আশা করিনি। ফলে আমি বেশ উৎসাহিত হয়েই আমার প্রেজেন্টেশন রেডি করি। এরপর সেটার ভেরিফিকেশন হয়। তখন আরও বেশি আশান্বিত হয়ে উঠি। শর্টলিস্টে আমার নাম উঠে আসে। এরপর একদিন সন্ধ্যায় আমার কাছে ফোন আসে আমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছি। তখনও আমি ঠিক এর ব্যাপ্তিটা বুঝে উঠতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার নেওয়ার পরে মনে হলো আমি আমার কাজের একটা স্বীকৃতি পেয়েছি। আমি যে মানুষের উপকারের জন্য কাজ করছি এটা দেশ বুঝতে পেরেছে বলে আমার মনে হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: স্মার্ট বাংলাদেশ পুরস্কার অর্জনের পেছনের গল্প তথা আপনার উদ্যোগের কথা যদি বলতেন।
মোবারক হোসেন: দীর্ঘদিন ধরেই প্রযুক্তি নিয়ে নিজস্বতা মিশিয়ে কিছু কাজ করছি। কেননা, বিদেশি কোম্পানিগুলো যেসব প্রযুক্তি ডেভেলপ করছে আমরা সেগুলোই ব্যবহার করছি। এজন্য দেশীয় প্রযুক্তি ডেভেলপ করার ব্যাপারে আমরা অনেক দিন ধরেই চেষ্টা করছিলাম। একপর্যায়ে চিন্তা করলাম, যেহেতু আমরা ইন্টারনেট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আছি তাই এটাকে মানুষের আরও কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় কিনা। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ অথবা যে কনটেন্টগুলো তৈরি করছে এই কনটেন্টগুলা যদি গ্রামের মানুষের কাছে না পৌঁছে তাহলে সত্যিকারের সুবিধা তারা পাবে না। কিন্তু মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে এটা করতে অনেক বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে। এই খরচটা আমরা কমানোর চেষ্টা করি। এটা অনেক চ্যালেঞ্জের কাজ ছিল। একপর্যায়ে এটা কমানো সম্ভব হয়। এখন পর্যন্ত আমরা দেশের প্রায় এক হাজারের বেশি গ্রামে পৌঁছাতে পেরেছি। মানুষের মাঝে এটা নিয়ে বেশ ভীতি ছিল। কেননা, এতে তাদের টাকা চলে যাচ্ছে। আমরা যেটা দিচ্ছি সেটা হলো মিনিমাম কোনও প্যাকেজ। হয়তো দেড়শ’ বা আড়াইশ’ টাকায় তাদের সারা মাস চলে যাচ্ছে। এত অল্প খরচে সারা মাস ইন্টারনেট দিতে পারায় গ্রামের মানুষের কাছে এটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার গড়ে তোলা ওয়াই-ফাই গ্রামের গল্পটা জানতে চাই।
মোবারক হোসেন: আমরা গ্রামে গ্রামে রাউটারের মাধ্যমে মানুষকে ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছি। যারা গ্রাহক হচ্ছেন তারা সবাই তাদের নিজের বাড়িতে রাউটার স্থাপন না করে যেখানে রাউটার স্থাপন করা হচ্ছে সেই কাভারেজ এরিয়ার বাইরে আরেকটা স্থাপন করছে। এতে রাউটারের সংখ্যা যেমন কমছে তেমনি ব্যবহারকারীরা গ্রামের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেটওয়ার্ক পেয়ে যাচ্ছেন। এমনকি কোনও চায়ের দোকানে গেলে গ্রামবাসী ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছেন। ফলে আমাদের এই উদ্যোগের কারণে সংশ্লিষ্ট গ্রামগুলোকে এলাকার লোকজন ওয়াই-ফাই গ্রাম বলছে। এমন গ্রামের সংখ্যা দেশে হাজারের বেশি, যেসব গ্রামকে আমরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগে রাউটার দিয়ে সংযুক্ত করেছি।
গ্রামের মানুষেরা আমাদের সহযোগিতার করছে। সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক খুবই দুর্বল। সেখানকার মানুষের কাছে থেকে আমরা খুবই ভালো রেসপন্স পাচ্ছি। তারা এতটাই উৎসাহিত, যেন তাদে ঈদ লেগেছে বলে মনে হচ্ছে। কেননা, সেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক খুব দুর্বল হওয়ায় তারা ইন্টারনেট, যেমন- হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে অনায়াসে কথা বলতে পারছেন এবং তাও খুবই কম খরচে।
বাংলা ট্রিবিউন: দেশে এর বিস্তৃতি কেমন?
মোবারক হোসেন: প্রথম ছয় মাসে আমরা মাত্র একটা ইউনিয়ন কাভার করতে পেরেছিলাম। পরে যখন এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে তখন দেখা গেছে এক মাসে আমরা ছয়টা ইউনিয়ন কাভার করে ফেলেছি। এখানে যেহেতু সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব বিনিয়োগ, এখান থেকে আমাদের যতটুকু উপার্জন হয় সেটা খাটিয়ে আমরা নতুন কোনও জায়গায় সেবার বিস্তৃতি ঘটাচ্ছি।
বাংলা ট্রিবিউন: খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিরাপত্তা একটা ইস্যু হতে পারে। কারণ, যার বাসায় এই ওয়াই-ফাই রাউটার থাকবে, এটা নিয়ে কোনও সমস্যা হলে তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে তাকেই আইনের আওতায় নেবে।
মোবারক হোসেন: একটা সমস্যা তো হচ্ছেই। ধরা যাক, গ্রামের একজন দোকানদার একটা ব্রডব্যান্ড লাইন নিয়ে রাউটারের মাধ্যমে ক্রেতাদের মাঝে ইন্টারনেট শেয়ার করছে। সেটা ব্যবহার করে যে কেউ একটা অপরাধমূলক কাজ করতে পারে। সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো সেই দোকারদারকেই ধরবে। এটাকে ঠেকানোর জন্য প্রত্যেক ব্যবহারকারীকে তার মোবাইল নম্বরের বিপরীতে সংযোগ নিতে হচ্ছে। আর বিটিআরসি’র নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যবহারকারীর লগ আমরা রেখে দিই। সুতরাং এক্ষেত্রে আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে পারি।
বাংলা ট্রিবিউন: দেশে দিন দিন ওয়াই-ফাই রাউটারের সংখ্যা বাড়ছে। আপনার এই উদ্যোগ রাউটারের সংখ্যা কমাতে সাহায্য করবে। রাউটার বেড়ে গেলে কি ধরনের সমস্যা হতে পারে?
মোবারক হোসেন: এটা খুব চমৎকার একটা ব্যাপার। অনেকের বাসায় এখন বলতে গেলে একাধিক রাউটার আছে। ঢাকা শহরের এমন কোনও স্থান নেই যেখানে ওয়াই-ফাই লাইন পাওয়া যায় না। কিন্তু একজনেরটায় আরেকজন ঢুকতে পারে না। সেখানে যদি একটু প্রযুক্তিগত আপডেট ঘটানো যায় তাহলে একটি স্থানে একটা রাউটার থেকেই সবাই নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ পেতে পারেন। একজন মানুষ ঘরে ব্রডব্যান্ডের বিল পরিশোধ করছে আবার রাস্তায় ব্যবহারের জন্য মোবাইল ডেটা কিনছে, তারপর তার অফিসের ইন্টারনেট বিল রয়েছে। এই প্রযুক্তি চালু করতে পারলে সে একটা জায়গায় বিল দিলেই সব স্থানে কাজ করতে পারবে। এই সুবিধা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে আমরা যদি এটা চালু করতে পারি তাহলে ঢাকা থেকে ৪০ শতাংশ রাউটার কমিয়ে ফেলা যাবে। অপরদিকে অতিরিক্ত রাউটার ব্যবহারের ফলে ফ্রিকোয়েন্সি নয়েজ তৈরি হচ্ছে। এতে রাউটারের ক্ষমতা কমে আসছে। এটা স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকর। সুতরাং এর পরিমিত ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।
বাংলা ট্রিবিউন: ক্লাউড সেবা এখন দেশেও দেওয়া হচ্ছে। দেশ এবং বিদেশের সেবার মধ্যে আসলে পার্থক্য কোথায়?
মোবারক হোসেন: আমাদের একটা দর্শন ছিল, আমরা সম্পূর্ণ দেশীয় সক্ষমতাকে ব্যবহার করবো। দেশের বাইরে আমরা এক ডলারও খরচ করব না। আমরা দেখলাম, এত বড় ডেটা আমরা নিজেরা ম্যানেজ করতে পারবো না। আমাদের ক্লাউডের দরকার। গত ৫ বছর ধরে আমরা আমাদের ওপেন সোর্সভিত্তিক অবকাঠামোটিতে (প্লেক্সাস ক্লাউড) সম্পূর্ণ নিজস্ব ক্লাউড ব্যবহার করছি। এর সুবিধা হলো, একটি বিশ্লেষণে আমরা দেখেছি ৯৫ শতাংশ ব্যবহারকারী লোকাল কনটেন্ট ব্যবহার করেন। শুধু ৫ শতাংশ লোকের ইন্টারনেটের দরকার বাইরের কনটেন্ট দেখার জন্য। সেক্ষেত্রে আমরা যদি আমাদের ডেটা লোকাল ক্লাউডে রাখি তাহলে বৃহৎ সংখ্যক ব্যবহারকারী ইন্টারনেট ছাড়াই এই কনটেন্ট ব্যবহার করতে পারবেন। এতে তারা স্পিডও ভালো পাবেন এবং নিরাপদও থাকবেন। কেননা, আমাদের দেশে সাইবার আক্রমণের বেশিরভাগই দেশের বাইরে থেকে হয়। অপরদিকে বিদেশি ক্লাউড ব্যবহার করলে ডলারে পেমেন্ট করতে হচ্ছে। অপরদিকে আমাদের দেশে বিদ্যুৎ খরচ, লেবার খরচ যেহেতু কম সুতরাং আমরা শুধু নিজেদের জন্য না, বরং এই ক্লাউড সার্ভিস আমরা বিদেশেও বিক্রি করতে পারবো।
বাংলা ট্রিবিউন: দেশীয় ক্লাউড কতটা নির্ভরযোগ্য?
মোবারক হোসেন: এ ক্ষেত্রে প্রথম বিষয় হলো এর জন্য পলিসি আছে কিনা। যে কেউ চাইলে ক্লাউডে ঢুকে সবার তথ্য হাতিয়ে নিতে যেন না পারে, এ ব্যাপারে শক্তিশালী নীতিমালা থাকতে হবে। এটা না থাকলে দেশের কেউ এবং দেশের বাইরের কেউ আমাদের লোকাল ক্লাউডে তথ্য রাখতে চাইবে না। আবার শুধু ডেটা সেন্টার তৈরি করলেই হয় না। সেটার কয়েকটি ধাপে ব্যাকআপও রাখতে হবে। সব ধাপে পুরোপুরি ডেভেলপ না করে এই পথে যাওয়াটা ঠিক হবে না। দেশীয় ক্লাউড ব্যবহার করলে দেশের টাকা দেশেই থাকবে।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনারা কীভাবে সেবা দিচ্ছেন? গ্রাহক সংখ্যা কেমন?
মোবারক হোসেন: আমরা অনেকটাই রিমোট ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করি। আমার একেকজন কর্মী একেক জেলায় থাকে। যেমন ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিকস, কলসেন্টার, সাপোর্ট ইত্যাদি কাজের জন্য তাদের অফিসে থাকার প্রয়োজন নেই। ঢাকার বাইরে থেকে তারা কাজ করতে পারে। এতে অফিসের খরচ যেমন আমাদের সাশ্রয় হচ্ছে আবার অনেক কম খরচে ভালো কর্মী আমরা রাখতে পারছি। কারণ, তখন কর্মীদের ঢাকায় থাকার প্রয়োজন হচ্ছে না। অনেকে নিজের বাসায় থেকেই কাজ করতে পারছে। এতে কর্মীরাও স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের সঙ্গে কাজ করছে, পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত জীবনকেও অনেক বেশি সময় দিতে পারছে। আমরা আমাদের কল সেন্টারে ভাষাভিত্তিক সাপোর্ট দিয়ে থাকি। যেমন, পার্বত্য এলাকায় অনেক ভাষাভাষী মানুষ আছে। তারা যেহেতু আমাদের সেবা ব্যবহার করছে, তাদের সাপোর্টটা স্থানীয় ভাষার মানুষদের দিয়েই দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
বাংলা ট্রিবিউন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মোবারক হোসেন: বাংলা ট্রিবিউনকেও ধন্যবাদ।