সমতট ডেক্স ; ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা যেই রণকৌশল দেখেছি, তা হচ্ছে ট্রেঞ্চযুদ্ধ। ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলিউশনের পরপর মেশিন গান আবিষ্কার হয়, যেই প্রযুক্তির ব্যবহারে প্রচুর পরিমাণে গোলা খুব কম সময়ের মধ্যে ছোড়া যায়। এই আবিষ্কারের কারণে ডিফেন্সিভ পজিশন ধরে রাখা আগের থেকে অনেক সহজ হয়ে যায়।
এই প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে অনেক ধরনের সামরিক প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়, যার মধ্যে রয়েছে নার্ভ গ্যাস (যেমন ক্লোরিন এবং মাস্টার্ড গ্যাস), যুদ্ধবিমান এবং যুদ্ধের শেষের দিকে যোগ হয় ট্যাংক।
যেসব প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছিল, তার মধ্যে ট্যাংক ছিল মিশনের জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকর অস্ত্র। গ্যাস প্রতিরোধ করার জন্য মাস্ক তৈরি হয়ে গেল। এ ছাড়া বাতাসের দিক পরিবর্তন হলে নিজেদের সৈন্য এবং বেসামরিক ব্যক্তিদেরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এই অস্ত্র। যার ফলে এই অস্ত্রের কার্যকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে এটির ব্যবহার সব দেশই বন্ধ করে দেয়।
অন্যদিকে ট্যাংকের যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন রণকৌশল এবং চিন্তায় দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন নিয়ে এলো। ট্রেঞ্চে বসে মেশিন গান দিয়ে হাজারো গুলি ছুড়লেও অগ্রসর বাহিনীর আর তেমন ক্ষতি করা যাচ্ছিল না, কেননা প্রতিপক্ষের সৈন্যরা ট্যাংকের পেছনে হেঁটে ট্রেঞ্চের দিকে অগ্রসর হতে পারছিল। এই সামরিক বাস্তবতার মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই ঐতিহাসিক ট্রেঞ্চ যুদ্ধ অপ্রচলিত হয়ে গেল।
এরপর শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ইতিহাসবিদরা ১৯৩৯-কে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু বলে ধরেন, কারণ ওই বছর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ এবং দখল করে। তবে কথাটা এক শ ভাগ শুধু না। এর আগেও বেশ কয়েকটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলছিল, যেমন চীন বনাম জাপান এবং ইতালি বনাম ইথিওপিয়া। কিন্তু পশ্চিমা শক্তির গায়ে আঘাত না লাগা পর্যন্ত তারা সেসব প্রাণঘাতী যুদ্ধ এবং গণহত্যাকে বিশ্বযুদ্ধের শুরু বলা হয় না। কিন্তু এই প্রবন্ধে সেই বিতর্কে আমি যাব না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রযুক্তি আরও অনেক অগ্রগামী হয়ে উঠল। ট্যাংক ও সাবমেরিন আরও ঢালাওভাবে ব্যবহার শুরু হলো।
এই প্রেক্ষাপটে জার্মানি ব্লিটজক্রিগ সামরিক কৌশল ব্যবহার শুরু করল, যার অর্থ হলো খুব কম সময় প্রচুর পরিমাণে ট্যাংক এবং বিমান দিয়ে শত্রুদের ডিফেন্স ভেঙে ফেলা এবং সেই ফাটল দিয়ে সেনাবাহিনী প্রবেশ করানো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ট্যাংক মোকাবিলা করার জন্য ছিল ট্যাংক ডেস্ট্রয়ার (ট্যাংকের মতোই তবে কামানের অনুপ্রবেশ ক্ষমতা অনেক বেশি এবং বর্ম তুলনামূলকভাবে কম), ট্যাংক, আর্টিলারি (কামান) এবং সামরিক বিমান।
এই চারটি বিকল্পের মধ্যে প্রথম দুটি ছিল বেশি কার্যকর। ট্যাংকের মতো একটি চলমান নিশানাকে ওই সময়ের বিমান কিংবা আর্টিলারি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা অনেক কঠিন ছিল। এর মূল কারণ হচ্ছে প্রিসিশন গাইডেড (নির্ভুলতা নির্দেশিত) প্রযুক্তি তখনও আসেনি। টার্গেটিং সলিউশনে সে সময় কম্পিউটার আবিষ্কার না হওয়ার কারণে ব্যবহার হয়নি। (কম্পিউটার দ্বিতীয় বিষয় যুদ্ধের শেষের দিকে আবিষ্কার হয়)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেশ কিছু বছর যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের আধিপত্য দেখা যায়। কিন্তু মিসর এবং ইসরায়েলের দ্বিতীয় সংখ্যাত, যাকে আমরা ইয়ম কিপুর যুদ্ধ বলে থাকি, সেখানে দেখা যায় কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্রের আধিপত্য। এই মিসাইলগুলো ট্যাংকের থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক কম দাম, অর্থাৎ সেগুলো খুব কম সময়, কম দামে, প্রচুর পরিমাণে তৈরি করা, কিংবা আমদানি করা সম্ভব। এই অস্ত্র দিয়ে একটি সাধারণ সৈন্য গোপন অবস্থান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে একটি দামি ট্যাংক ধ্বংস করতে পারে। এই অস্ত্রের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ সময় ট্যাংকের থেকে কম।
ট্যাংক সৃষ্টির প্রধান কারণ ছিল শত্রু দুর্গ এবং প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান ধ্বংস করা এবং সাধারণ সৈন্যদের শত্রুদের অবস্থানে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু এই অস্ত্রের আগমনে ট্যাংকের সৃষ্টির উদ্দেশ্য খানিকটা অপ্রচলিত হয়ে গেল।
আধুনিক কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র যেমন মার্কিন জ্যাভেলিন এবং ব্রিটিশ এনল বলে পরিচিত, সেগুলো মোটামুটি সব অত্যাধুনিক ট্যাংক ধ্বংস কিংবা ক্ষতি করতে সক্ষম। আমরা তার উদাহরণ দেখছি চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে। ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধেও আমরা দেখতে পেলাম অতি নিম্নমানের কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র দিয়েও পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুরক্ষিত এবং আধুনিক মার্কাভা ট্যাংকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে।
রাশিয়ার দ্বিতীয় চেচনিয়া যুদ্ধেও দেখা গেল শহরের ভেতরে ট্যাংক নিয়ে প্রবেশ করার প্রতিকূলতা। ট্যাংকের কামান ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রির বেশি মাথা উঁচু করতে পারে না, যার অর্থ ছাদের ওপর থেকে কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র দিয়েই চেচনিয়া সৈন্যরা ট্যাংক ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল।
এটি দেখার পর পৃথিবী কম্বাইন্ড আর্মস ডকট্রিনে অ্যাডপ্ট করে, যার অর্থ ট্যাংককে রক্ষা করার জন্য অন্যান্য সামরিক অস্ত্র এবং সৈন্য যোগ করা। এককভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো আর প্রচুর পরিমাণের ট্যাংক দিয়ে এক জাগায় আর আক্রমণ আমরা দেখিনি।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আমরা যা দেখতে পাই, তা হচ্ছে কম্বাইন্ড আর্মস ডকট্রিনেও এখন আর কার্যকর রণকৌশলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা ২০২৩ সালে অত্যাধুনিক পশ্চিমা ট্যাংক এবং সেই ট্যাংক রক্ষা করার জন্য আর্মার্ড ফাইটিং ভেহিকল দিয়ে ইউক্রেন রাশিয়াকে পাল্টা আক্রমণ করে। এই পাল্টা আক্রমণে তারা অপমানজনকভাবে পরাজিত হয়, যা প্রমাণ করে যে আধুনিক যুদ্ধে ট্যাংকের ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয়তা যুদ্ধবিমানের মতো কৌশলগত।
রাশিয়া নিজেও তাদের ট্যাংককে কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ট্যাংকে সুরক্ষিত করে ব্যর্থ হয়।
তাহলে কোন অস্ত্র আধুনিক স্থলযুদ্ধে কার্যকর?
অবশ্যই কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র। কিন্তু আমরা ইউক্রেন থেকে আরও যা শিখলাম, তা হচ্ছে ড্রোনের আধুনিক রণমঞ্চে প্রয়োজনীয়তা। ড্রোনে দিয়ে শত্রুদের ওপর নজরদারি করা যায়, যেই তথ্য দিয়ে তাদের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে একত্র করা যায়।
ড্রোন প্রযুক্তির সুবিধা শুধু নজরদারিতা না। ড্রোন দিয়ে আমরা শত্রুদের সুনির্দিষ্ট অবস্থানে আক্রমণ করা সম্ভব, যা আমরা ইউক্রেন যুদ্ধে দেখেছি।
এ ছাড়া কাঁধে বহনযোগ্য অ্যান্টি-ট্যাংক অস্ত্র, যেই ট্যাংক ধ্বংসকারী বিস্ফোরক কাঁধ থেকে নিক্ষেপ না করে, সেটা আমরা ড্রোন দিয়ে অনেক দূরে থাকা শত্রুর ট্যাংক ধ্বংস করতে পারি।
যদিও ড্রোন প্রযুক্তি প্রতিহত করতে এখন ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং অ্যান্টি-ড্রোন অস্ত্র তৈরি হচ্ছে। যেটা আমাদের তৈরি কিংবা আমদানি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া কাউন্টার ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার প্রযুক্তিও আমাদের আমদানি করা প্রয়োজন।
সোয়ার্ম ড্রোন প্রযুক্তি (Swarm Drone Technology) বলতে এমন একটি উন্নত প্রযুক্তিকে বোঝায়, যেখানে একাধিক ড্রোন একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে দলবদ্ধভাবে কাজ করে। এই ড্রোনগুলো একসঙ্গে সমন্বিতভাবে বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করতে পারে, যেমন নজরদারি, অনুসন্ধান ও সামরিক অপারেশন। স্বর্ম ড্রোন প্রযুক্তি প্রাকৃতিক মৌমাছি বা পাখির ঝাঁকের মতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে কাজ করে, যা তাদের কার্যক্ষম ও কার্যকর করে তোলে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে ড্রোন তৈরি করতে শুরু করেছে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। ড্রোন অপারেটরের যুগ বেশি দিন থাকবে না। আমরা যদি প্রচুর পরিমাণে ড্রোন দিয়ে সমন্বিত আক্রমণ করতে চাই, তাহলে আমাদের ড্রোনে এআইচালিত সোয়ার্ম প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত এবং আধুনিকায়ন করতে হবে।
এই প্রযুক্তির ওপর চীন ইতোমধ্যে জোর দিয়েছে এবং তাদের প্রোটোটাইপ প্রদর্শন করেছে। যেহেতু এই প্রযুক্তি কার্যকর এবং অন্যান্য আধুনিক সামরিক প্রযুক্তির তুলনায় অনেক কম ব্যয়বহুল, আমাদের এই প্রযুক্তি আমদানি করে সেনাবাহিনীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এন্টি ড্রোনে অস্ত্রের স্বরূপটির কারণে আমাদের নিকট ভবিষ্যতের রণমঞ্চে এআইচালিত মাস ড্রোন দিয়ে শত্রুর দুর্বল পয়েন্টে একত্র করতে হবে। আধুনিক যুদ্ধে আমাদের কৌশল-যত্ন-আধিপত্য রক্ষা করতে হলে এই প্রযুক্তি দিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীকে আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন।