সমতট ডেক্স: সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে রহস্যজনক আগুনের ঘটনায় তদন্ত ও অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি। আগুনের এ ঘটনাকে অস্বাভাবিক ধরে নিয়ে জনপ্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পুলিশের আইজি, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগ, তড়িৎ বিভাগ ও কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষকদের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটিতে যুক্ত করেছে সরকার। আগুনের ঘটনার পেছনে কারও ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায়-দায়িত্ব আছে কি না, তা উদঘাটনের জোর দিতে বলা হয়েছে তদন্ত কমিটিগুলোকে।
গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে সকাল থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে কমিটিগুলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইমসিন ইউনিট ও ফরেনসিক বিভাগ। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বিকল্প কার্যালয়ের ব্যবস্থা করতে কাজ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। সচিবালয়ে নজরদারি বাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরেজমিনে সচিবালয়ে গিয়ে এমন তথ্য জানা যায়।
সচিবালয় থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন দমকল বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) ও গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। তিনি বলেন, ‘আমরা তদন্ত শুরু করেছি। তদন্তে সবগুলো বিষয় দেখা হচ্ছে। আপাতত এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে। এতে ওই ভবনের বিভিন্ন তলায় থাকা পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের নথি পুড়ে যায়। এ ঘটনাকে নাশকতা হিসেবে দেখছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নাগরিকরা। এ ঘটনার অস্বাভাবিকতা বিবেচনায় নিয়ে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট তিনজন উপদেষ্টা। তারা ঘটনার আপডেট প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়কে অবহিত করছেন বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা।
তদন্ত শুরু করেছে কমিটি
গত বৃহস্পতিবার আগুনের ঘটনার পর পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে তদন্ত করার জন্য এসব কমিটি করা হয়। বৃহস্পতিবার প্রথমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসন ও শৃঙ্খলা শাখা থেকে প্রথম কমিটি গঠনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন শাখার অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীমকে। সাত সদস্যের এ কমিটিতে জননিরাপত্তা বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধি এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
এ কমিটি গতকাল থেকে আগুনের উৎস ও কারণ উদঘাটনে কাজ শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এ আগুনের ঘটনার পেছনে কারও ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায়-দায়িত্ব আছে কি না, সেটাও দেখছে এ কমিটি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গণিকে আহ্বায়ক করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটিও গতকাল সকাল থেকে তাদের তদন্ত ও অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। এ কমিটির অপর সদস্যরা হলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি), গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর মনজুর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কমান্ডেন্ট সিএমটিডি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রাসেল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ইয়াছির আরাফাত খান, প্রকৌশল বিভাগের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। গতকাল সচিবালয়ে এ কমিটি প্রথমে বৈঠক করে তদন্তের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। এ কমিটিকেও আগুন লাগার পেছনে কারও ব্যক্তিগত বা পেশাগত দায়-দায়িত্ব আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (প্রশাসন) আহ্বায়ক করে গঠিত সাত সদস্যের তৃতীয় তদন্ত কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের। এ কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ তদন্তে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেছে। গতকাল সচিবালয় কমিটির সদস্যরা বৈঠক করে দ্রুত তদন্ত শেষ করার বিষয়ে আলোচনা করেন বলে আমার দেশকে জানিয়েছেন কমিটির একজন সদস্য।
আলামত খতিয়ে দেখছে সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট
গতকাল সরেজমিনে সচিবালয়ে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৭ নম্বর ভবন এবং এর চারপাশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট। ভবনের আশপাশে কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। কোনোভাবেই যেন আলামত নষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন ক্রাইমসিন ইউনিটের সদস্যরা।
সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল থেকে আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করে সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট। সিআইডির কেন্দ্রীয় ফরেনসিক বিভাগের সব জনবল আলামত সংগ্রহের কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ভবনের চারপাশের আলামত সংগ্রহের কাজ শেষ হয়েছে। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৭ নম্বর ভবনের নিচতলা থেকে শুরু করে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করার কাজ শেষ হয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত আলামত সংগ্রহের কাজ করে তারা। অন্যান্য তলার আলামত সংগ্রহের কাজ আজ শনিবার আবার শুরু করবে বলে জানান ইউনিটের একজন সদস্য। আলামত সংগ্রহ শেষে দ্রুততম সময়ের রিপোর্ট তৈরির চেষ্টা করছে সিআইডি। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে তা বুঝিয়ে দেবে সিআইডি।
আলামত সংগ্রহের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, ঘটনাস্থল ভবনটির প্রতিটি তলার প্রতিটি কক্ষ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফরেনসিক আলামত সংগ্রহ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। আলামত সংগ্রহের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে সংখ্যা জানাতে রাজি হয়নি সিআইডির ওই কর্মকর্তা।
কত দিনের মধ্যে ফরেনসিক রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে দিতে হবে এমন কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের না সূচক জবাব দেন সিআইডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখা হচ্ছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
পুড়ে যাওয়া নথি নিয়ে যা ভাবছে সরকার
আগুনে ৫টি মন্ত্রণালয় এবং আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি শাখার নথি পুড়ে গেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পুড়ে যাওয়া এসব নথিতে কী ছিল এবং এগুলো উদ্ধারের বিষয়ে সরকার কী করছে, এমন প্রশ্ন ছিল একজন উপদেষ্টার কাছে। আমার দেশকে তিনি বলেন, এ ঘটনা অনুসন্ধান ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য আমরা পৃথক একটি কমিটি করে দিয়েছি। আশা করছি ওই কমিটি পুরো বিষয়টি বের করতে আনতে সক্ষম হবে। আমরা এরই মধ্যে জনপ্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তারা সঠিকভাবেই কাজ করছে।
পুড়ে যাওয়া নথির বিকল্প কী, এমন প্রশ্নও ছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে। আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘সবকিছুরই বিকল্প থাকে। সচিবালয়ে যেসব নথি থাকে তার ছায়া নথি বিভিন্ন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর শাখা অফিসগুলোয় থাকে। এসব অফিসগুলোর বেশির ভাগই সচিবালয়ের বাইরে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত। কাজেই নথি পেতে আমাদের খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনপ্রশাসনে ই-নথির ব্যবস্থা আছে। পুড়ে যাওয়া নথির সবগুলোই আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করব, এ জন্য হয়তো আমাদের কিছু সময় লাগতে পারে।
খোঁজা হচ্ছে বিকল্প অফিস
বুধবার গভীর রাতে আগুনে সচিবালয়ের তলা বিশিষ্ট ৭ নম্বর ভবনের ওপরের চারটি তলা পুড়ে গেছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুরো ভবনটি। সিঁড়ি ও লিফট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুরোপুরি। তদন্তের স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরো ভবনটি কর্ডন করে রেখেছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ভবনটিতে তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া অন্য কাউকে এ ভবনটিতে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন সচিবালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
এ ভবনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। গত বুধবার রাতে এ ভবনে আগুন লাগে। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ের অন্যান্য ভবনের কার্যক্রম সীমিত পর্যায়ে চললেও ৭ নম্বর ভবনে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এ ভবনে থাকা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিব ও অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন কোথায় বসে দাপ্তরিক কাজ করবেন, সেটা নিয়ে গতকাল সরকারের উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আলোচনা করেন।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, সাপ্তাহিক ছুটি শেষে রোববার থেকে সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে সীমিত পর্যায়ে হলেও বসার বিষয়ে কাজ চলছে। ঢাকার কয়েকটি জায়গায় সরকারি দপ্তরগুলোয় সাময়িকভাবে বসার ব্যবস্থা করতে গণপূর্ত বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা শুক্রবার দিনভর বিভিন্ন পরিদর্শন করেছেন করেছেন।