দীর্ঘদিনের প্রচলিত ঈদ বকশিশ সাম্প্রতিককালে সালামি নামেই বেশি পরিচিত। পরিবারে, পাড়া-মহল্লায় বড়দের কাছে ছোটদের আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ সালামি অফিস-আদালতেও বিস্তৃতি পেয়েছে। সাপ্তাহিক ও শবেবরাতের ছুটির পর পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে গতকাল সোমবার ও আজ মঙ্গলবার দু’দিন সরকারি অফিস খোলা। দেশের মন্ত্রী-সচিবদের দপ্তর সচিবালয়ে গতকাল নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উচ্চপদের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সালামি নেন কর্মচারীরা। তবে গণহারে সালামি দাবি করায় কোনো কোনো কর্মকর্তার কাছে তা উৎপাতে পরিণত হয়েছে।
গতকাল বিকেল পৌনে ৩টার দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার কক্ষে তিন কর্মচারী প্রবেশ করেন। কুশলাদি জেনে ওই কর্মকর্তা তাদের একটি করে খাম দেন। প্রতি খামে রয়েছে একটি হাজার টাকার নোট। সোমবারসহ গত সপ্তাহের প্রতিদিন সচিবালয়জুড়ে এমন চিত্রের দেখা মেলে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব বলেন, নিজের বোনাসের চেয়ে বেশি টাকা সালামি দিতেই চলে গেছে। বছর ঘুরে আনন্দের উপলক্ষ আসে, যত বেশি মানুষকে দিতে পারি, ততটাই খুশি লাগে। মুশকিল হলো কেউ হয়তো অবৈধভাবে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন, একেকজনকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিচ্ছেন, সেটা তো আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে গ্রহীতার মুখ কালো হচ্ছে অনেক সময়। কোনো কিছুই আসলে সীমার বাইরে যাওয়া কাম্য নয়।
একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও দেহরক্ষী দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ওই মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চপদের এবং মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ফোন করে সালামি চাইছেন। ওই দু’জন অনেককে যেচে নগদ ও বিকাশ নম্বর দিচ্ছেন। একজন ঠিকাদার গত বৃহস্পতিবার অনুযোগের সুরে মন্ত্রীর একান্ত সচিবকে বলছিলেন, ফোনে অ্যাকাউন্ট নম্বরও পাঠানো হচ্ছে। মন্ত্রীর জন্য তো এটি নিঃসন্দেহে বিব্রতকর।
গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে দেখা গেছে নিজের কক্ষের পাশে সহকর্মীর কক্ষে গিয়ে বসে কাজ করছেন। তিনি বলছিলেন, সালামির দাবি মেটাতে মেটাতে ক্লান্ত, তাদের কারণে কাজও করা যাচ্ছে না। এই কক্ষের কর্মকর্তা ছুটিতে গেছেন বিধায় এখানে এসে একটু স্বস্তিতে হাতের কাজগুলো সারছি।
এ নিয়ে সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সমকালকে বলেন, সাধারণত অফিস সহকারী, দ্বাররক্ষক বা লিফটের কর্মীদের কিছু দেওয়াটা রেওয়াজ। সবাই দিয়েও আসছেন দীর্ঘকাল। কিন্তু এখন এটি দাবিতে পরিণত হয়ে গেছে, যা আসলে আমাদের ন্যায়নীতি, সৌজন্য ও সভ্যতা-ভব্যতা বোধের দুর্ভিক্ষের সূচক। স্বভাবগত সৌজন্যতার জায়গায় আমাদের অধঃপতন হয়েছে। কম দিলে বা কেউ যদি না দেন সেটি তাঁর জন্য বিব্রতকর, দেখা যায় পেছনে কটুকথা বলে। এমন নয় যে কর্মচারীরা বোনাসের পয়সা পাচ্ছে না। এর পরও দেওয়া যেতেই পারে, আমরাও দিয়েছি। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিটা ভিন্ন। এটি আসলে ওপর থেকে আসছে, উচ্চপদেরা বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে যত দেওয়া হচ্ছে, তত তাদের খাই খাই মানসিকতা দেখা যাচ্ছে। এটা যেমন দুঃখজনক, তেমনি কর্মচারীরা সামাজিক ভব্যতা বিসর্জন দিয়ে সালামিকে দাবি মনে করে নিচ্ছেন, তা আমাদের চারিত্রিক দারিদ্র্যের প্রমাণ।
সচিবালয়ে ঈদ সালামি আদান-প্রদানের বাইরে ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর পক্ষ থেকে জমকালো বাক্স ও ব্যাগে ঈদ উপহার পাচ্ছেন অনেক পদস্থ কর্মকর্তা। ওই সব বাক্স ও ব্যাগে নামিদামি ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি, জায়নামাজ, আতর, খেজুর ও টুপি থাকছে।
ইয়াসির আরাফাত