রোহিঙ্গারা ‘বিদেশি’ নয়, মায়ানমারের নাগরিক, আরাকানের ভূমিপুত্র: মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের ঐতিহাসিক অধিবাসী রোহিঙ্গারা শতাব্দীপ্রাচীন এক জনগোষ্ঠী, যারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও রাজনৈতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। তবুও, আজ তাদেরকে ‘বিদেশি’ বা ‘বাঙালি’ বলে আখ্যা দিয়ে একপেশে প্রচার চালানো হচ্ছে, যা তাদের প্রকৃত ঐতিহ্য ও পরিচিতি বিলোপের এক হীন প্রচেষ্টা। বিশেষ করে, ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদেরকে রাষ্ট্রহীন হিসেবে পরিণত করেছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: আরাকানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের গভীর সম্পর্ক
রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের ভূমিপুত্র বলে দাবির একটি শক্তিশালী ভিত্তি হলো তাদের ঐতিহাসিক উপস্থিতি। ১৪০০ শতকের পূর্বেই ম্রাউক ইউ রাজ্যের শাসনামলে মুসলিম বণিক ও সৈন্যরা রাখাইনে বসতি স্থাপন করে, এবং এই জনগোষ্ঠী স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত হয়। রাজা নারমিখলার আমলে মুসলিম সৈন্য ও সৈন্যনেতাদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরাকানের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়। এই সময় আরাকানে রোহিঙ্গারা কেবল সমাজের অংশ নয়, বরং প্রশাসনিক ও সামরিক বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন, যা প্রমাণ করে তাদের কোনো বহিরাগত নয় বরং স্থায়ী অধিবাসী হিসেবে মায়ানমারের আরাকানে বাস করে আসার বিষয়টি।
রাখাইনদের প্রোপাগান্ডা ও বাস্তবতা
রাখাইন জনগোষ্ঠীর একাংশের দাবি, রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে অভিবাসিত মুসলিম জনগোষ্ঠী। তবে, এই ধারণার ভিত্তি ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। ব্রিটিশ শাসনের আগে থেকেই রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস করছিল, এবং তখন থেকেই তারা মায়ানমারের জনগোষ্ঠীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। রাখাইনদের প্রোপাগান্ডার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে, যা রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করতে একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ইতিহাসের নির্ভুল অনুসন্ধানে দেখা যায় যে রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের আগমনের বহু আগে থেকেই আরাকানে বসবাসরত এক জনগোষ্ঠী।
রোহিঙ্গা ভাষার বৈচিত্র্য ও সংস্কৃতি
রাখাইনদের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ভাষা চট্টগ্রামের উপভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং সে কারণে তারা বাংলাদেশ থেকে আসা জনগোষ্ঠী। যদিও রোহিঙ্গা ভাষায় কিছু চট্টগ্রামের উপভাষার প্রভাব আছে, তবুও এটিকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা, যাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব থাকলেও এর নিজস্ব কাঠামো এবং শব্দভাণ্ডার রয়েছে। ভাষার কিছু বৈসাদৃশ্য থাকার মানে এই নয় যে রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয়কে অন্য একটি দেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিতে হবে।
১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন: বৈষম্যের কৌশল
মায়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমে তাদের মায়ানমারের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে একটি বৈষম্যমূলক কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামল শেষে ১৯৪৮ সালে নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই স্বীকৃতির ভিত্তিতে রোহিঙ্গারা সরকারি কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, রাজনীতিতে ভূমিকা এবং সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়নে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন তাদের নাগরিকত্বকে কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে রাষ্ট্রহীন করে তোলে। এই আইন জাতিগত ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক এবং এটি রোহিঙ্গাদের প্রতি মায়ানমারের বৈরী মনোভাবের একটি প্রাতিষ্ঠানিক উদাহরণ।
রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক অবদান ও এম.এ. রশিদ:
মায়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামে রোহিঙ্গাদের অবদান উপেক্ষা করা অন্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন এবং মায়ানমারের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। এম.এ. রশিদসহ অনেক রোহিঙ্গা নেতা মায়ানমারের রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন এবং দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এম.এ. রশিদ অং সানের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন এবং স্বাধীনতার পর রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য হিসেবে মায়ানমারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অবদান রেখেছিলেন। তার পাশাপাশি, কাবি ফয়েজউল্লাহ, সুলতান মাহমুদ, আব্দুল গফুর, এবং আলী আহমদসহ আরও রোহিঙ্গা নেতারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান
রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের ঘটনায় মায়ানমার সরকারের পদক্ষেপের নিন্দা করেছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের আদিবাসী জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তাদের নাগরিকত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। এটি নিশ্চিত করে যে, রোহিঙ্গারা কেবল মানবিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত নয় বরং তাদের প্রকৃত জাতিগত পরিচয়কেও বিলোপ করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।
উপসংহার
রোহিঙ্গাদের উপর চলমান নির্যাতন একটি জাতিকে নিপীড়িত করে তাদের ভূমি থেকে বিতাড়িত করার চক্রান্ত ছাড়া কিছু নয়। রোহিঙ্গারা মায়ানমারের নাগরিক, তাদের জাতীয় পরিচয়, ভাষা, এবং সামাজিক অবদান মায়ানমারের একটি বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী হিসেবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এম.এ রশিদ এবং অন্যান্য রোহিঙ্গা নেতারা মায়ানমারের উন্নয়নে যে অবদান রেখেছেন, তা তাদের অবিচ্ছেদ্য নাগরিকত্বের প্রমাণ বহন করে। জাতিগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের প্রতি মায়ানমারের শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মানবাধিকার ফিরিয়ে দিয়ে দেশটিকে আরও উদার ও মানবিক করে গড়ে তোলা উচিত।
লেখক: জামিউল আহসান সিপু ,সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক ইত্তেফাক