আবুল কাসেম ফজলুল হক: সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কথা ভাবছে। ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, সরকার এটা ভাবতেই পারে। যেহেতু বিভিন্ন মহল থেকে তাদের নিষিদ্ধ করার বিষয়ে চাপ আছে, এমনকি তাদের যারা ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও তাই চাচ্ছেন। কিন্তু এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সরকারকে সবসময় জনপ্রিয় বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতে হয় না। আমার মতে, নিষিদ্ধ করা সমীচীন হবে না। বিশে^ বিভিন্ন সময় যেসব দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, পরে তারা কিন্তু রাজনীতিতে ফিরে এসেছে এবং দেখা গেছে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। নিষিদ্ধ করার চেয়ে বরং এই দুটি সংগঠনের যেসব নেতার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিলে ভালো হতো।
আরেকটা বিষয় জরুরি, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের যেসব নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে ঢালাও হত্যা মামলা দেওয়াও ঠিক হচ্ছে না। যে যেই অপরাধ করেছে, তাকে সে অনুযায়ী বিচার করতে হবে। যার বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে, তাকে সেই মামলা দিতে হবে। তা না হলে এসব মামলায় সাজা দেওয়ার সুযোগ কমে যাবে। মাথায় রাখতে হবে, বিচার যত প্রলম্বিত হবে, মানুষ তত সরকারের ওপর বিরক্ত হবে।
৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন, ক্ষমতায় বসে তা দ্রুতই তিনি হারান। জাতির অবিসংবাদিত নেতা হতে গেলে যেসব মনোভাব ও রীতিনীতি থাকার কথা, ক্ষমতায় বসার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সরকার তা ধরে রাখতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু উদারতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। পুরো জাতির নেতা যার হওয়ার কথা ছিল, তিনি হয়ে উঠলেন আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা। তার সরকারের অধীনে প্রথম যে নির্বাচন হয়েছিল, সেটি নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। তার অনেক সিদ্ধান্ত দেশের জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ করেনি। পরে তার দল আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় এলেও বঙ্গবন্ধুকে দলের বাইরে যেতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কিংবা তার দল আওয়ামী লীগ উদারতার পরিচয় যেমন দেয়নি, তেমনি তারা বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করেছে। যার ফল হিসেবে আজ বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা একই জায়গায় চলে গেছেন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর আওয়ামী লীগের অধীনে ১৪, ১৮ এবং ২৪ সালে তিনটি নির্বাচন হয়। এখন বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠছে, এই তিনটি নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করার। আমার কাছে মনে হয় এই দাবিটি যুক্তিযুক্ত। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ মহলেই এই তিন নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। জনগণ ভোট দিতে পারেননি। যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই এসব নির্বাচন হয়েছে, তাই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়ার মধ্য দিয়ে সেই মূল্য চুকাতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দোটানায় রয়েছেন। তাকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিল আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা সরকার। শুরু থেকেই তিনি নির্দলীয় ছিলেন না, এমনকি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও তিনি দলের ঊর্ধ্বে গিয়ে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের অভিভাবক হয়ে উঠতে ব্যর্থ হন। রাষ্ট্রপতির উপলব্ধি করা উচিত ছিল এটা আওয়ামী লীগ সরকার নয়, একটা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে আরেকটি সরকার দায়িত্ব পালন করছে। তা ছাড়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসেবে তিনি মিথ্যা বলতে পারেন না।
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি। অন্যদিকে তিনি নিজেই ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন। এখন আমরা যদি এই দুটি বক্তব্যকে সামনে রাখি, তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে হবে, রাষ্ট্রপতির যেকোনো একটা বক্তব্য সত্য নয়। এখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসেবে তিনি কোনো মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। কিংবা জাতিকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারেন না। এই দ্বিচারিতার কারণে তার শপথ লঙ্ঘন হয়েছে এবং রাষ্ট্রপতি পদে থাকার নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি তিনি হারিয়েছেন।
এখানে খেয়াল রাখতে হবে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা চেয়ে সংবিধানের ১০৬ ধারায় সুপ্রিম কোর্টের কাছে একটি রেফারেন্স পাঠান। সেই রেফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, এমন কথা উল্লেখ করে তিনি সৃষ্ট পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের কাছে জানতে চান। সুপ্রিম কোর্ট মত দেয়, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে তার সরকার শপথ নেয়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাষ্ট্রপতি হাসিনার পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত অবস্থা রাজনীতিতে বিরাজ করছে। আর এই প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তার পদত্যাগের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। তারা বঙ্গভবন ঘেরাও করেছেন। শুধু ঢাকায় নয়, বিভিন্ন বিভাগীয় শহরেই একই দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। আমরা যদি বর্তমান শাসনক্ষমতায় থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে তাকাই, তাহলেও কিন্তু দেখা যায় তারাও রাষ্ট্রপতিকে রাখতে স্বস্তিবোধ করছেন না। সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার বক্তব্যে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র না পাওয়ার বক্তব্যে রাষ্ট্রপতির ‘শপথভঙ্গ’ এবং তার ‘পদে থাকার যোগ্যতা নিয়ে ভাবতে হবে’ বলে জানিয়েছেন। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার একমত বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে।
এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করবেন, নাকি তাকে অপসারণ করা হবে এ নিয়ে নানা মত দেখা যাচ্ছে। সংসদ বহাল থাকলে রাষ্ট্রপতিকে সংসদের মাধ্যমে অভিশংসন করা যেত। কিন্তু এখন সংসদ বহাল নেই। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ না করলে তাকে সংবিধান মেনে অপসারণের সুযোগ নেই। কিন্তু এখানে মাথায় রাখতে হবে, বর্তমান সরকার যে প্রক্রিয়ায় গঠন হয়েছে কিংবা এ সময়টাকে যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে উপলব্ধি হয় সবকিছু সংবিধান মেনে চলছে না কিংবা চলার সুযোগও নেই। ফলে রাষ্ট্রপতি নিজ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকার ও তার উপদেষ্টারা তাকে পদত্যাগে চাপ দিতে পারেন। তাতেও কাজ না হলে সরকার চাইলে জনদাবিকে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে বিদায় জানাতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে সংবিধান মেনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়নি, সংবিধানে এই প্রক্রিয়া এখন বলবৎ নেই।
এখন রাষ্ট্রপতিকে যদি অপসারণ করা হয় কিংবা তিনি পদত্যাগ করেন, তাহলে দায়িত্ব পালন কে করবেন, সেই প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এ ক্ষেত্রে স্পিকারের দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ ছিল। কিন্তু স্পিকার আগেই পদত্যাগ করায় সেই সুযোগ সরকারের সামনে নেই। এ ক্ষেত্রে সরকার আবার আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। আদালত যে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দেবে, সরকার সে অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাউকে নিযুক্ত করতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতিকে যেমন দায়িত্ব দেওয়া যায়, তেমনি অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতি কিংবা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য কাউকে বিবেচনা করতে হবে। অনেক জায়গায় এমন আলোচনা চলছে, প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রপতি করার। আমার মতে, এটা বুমেরাং হবে। তিনি যে পদে আছেন, সেই পদে থেকেই দায়িত্ব পালন করে যাওয়া উচিত।
রাষ্ট্রপতির উচিত ছিল সময়কে বিবেচনায় নিয়ে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি যত চাপ থাকুক, তা উপেক্ষা করে নির্মোহ থাকা। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, তিনি তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে দল থেকে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকে তার ওপর অদৃশ্য চাপ থাকতে পারে অথবা রাষ্ট্রপতি তার আনুগত্য থেকে সেই দলের হয়ে কাজ করতে পারেন। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে, আপাতত সামনের পথ দিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ নেই। ফলে বিভিন্ন মহল সন্দেহ করছে, আওয়ামী লীগ যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করবে। সরকারকে এটা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে।
অন্যদিকে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সরকার যে কর্মকান্ড, তাতেও পুরোপুরি জন-আকাক্সক্ষা পূরণ হচ্ছে না। সরকারের যারা উপদেষ্টা রয়েছেন, তাদের সবাই ছাত্রজীবনে ক্লাসে প্রথম ছিলেন এবং কর্মজীবনে তারা সফল। কিন্তু তাদের অনেকের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা সেভাবে কখনো ছিল না। ফলে জনগণ কী চান, তারা তা উপলব্ধি করছেন না। সরকারের সেসব জায়গায়ও নজর দিয়ে শাসন করতে হবে, নতুবা জনপ্রিয়তা হারাবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বলব, রাষ্ট্রশাসন কিংবা সংস্কার এসব জটিল বিষয়। এ ক্ষেত্রে জনগণের প্রকৃত চাহিদা ও মতামত বুঝে নির্মোহ থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে পরিবর্তন ও রাষ্ট্র সংস্কার অনেক কঠিন হবে এবং জনগণ হতাশ হয়ে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবেন।
আমাদের দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে কি এমন কোনো নেতা তৈরি আছেন, যারা জাতিকে পথ দেখাতে পারেন? উত্তর হচ্ছে না, পারেন না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও নেতা তৈরির জন্য আদর্শ নয়। একই কথা বলা যায় অন্য রাজনৈতিক দলগুলো নিয়েও। একটা সময় আমাদের বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের দল মনে করা হতো। কিন্তু দিনে দিনে বামরা জনগণ থেকে দূরে সরে গেছে। এখন এই যে নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হয়েছে, এটা আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা আশু প্রয়োজন।
লেখক : গবেষক, সমাজবিশ্লেষক ও চিন্তাবিদ