প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৫, ১০:৪৫
সমতট ডেস্ক: বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা একসময় রাজনৈতিক মতপ্রকাশ দমন এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করার একটি সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিচার প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে আইনি বিকৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার মাধ্যমে বিরোধীদের অপরাধী বানানো হতো, যা মৌলিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
গত ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। আজ সোমবার প্রতিবেদনটির কয়েকটি অধ্যায় সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে:
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, (হাসিনার জমানায়) আদালত ও প্রসিকিউশনের কাঠামো নাগরিক অধিকার রক্ষা এবং সুবিচার নিশ্চিত করার বদলে রাজনৈতিক নিপীড়নের জন্য ব্যবহৃত হতো। মামলার ধরন ও বিচার ব্যবস্থা আইনকে বিকৃত করার ফলে সাধারণ মানুষের আস্থা কমে গিয়েছিল।
দেশের বিভিন্ন জেলার বহু গুম ও জোরপূর্বক আটক ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে কমিশন জানিয়েছে, স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য একটি সংগঠিত পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল। এটি ভয়ভীতি, জোরপূর্বক চাপ ও আইনি প্রক্রিয়া লঙ্ঘনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। ভুক্তভোগীদের ১৬৪ ধারার আওতায় জবানবন্দি না দিলে বা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নির্ধারিত বক্তব্য না দিলে ভয়াবহ শাস্তির হুমকি দেওয়া হতো, যার মধ্যে সরাসরি হত্যার হুমকি, দীর্ঘদিন গুম রাখা, পরিবারের ওপর হুমকি বা মিথ্যা মামলা দায়েরের ভয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
একজন ভুক্তভোগী কমিশনের কাছে জানান, “আমাকে সারা রাত ধরে রেখে বলেছে, তুমি যদি স্বীকারোক্তি না দাও, তাহলে তোমার স্ত্রীকে নিয়ে আসব, তাকে মেরেই ফেলব। এখানে কোনো পুলিশ নেই, কেউ কিছু করতে পারবে না।” আরেক ভুক্তভোগী বলেন, “চার মাস আটক থাকার পর একদিন চোখ বেঁধে নিয়ে আমাকে বলল, তুমি কি এখান থেকে বের হতে চাও? যদি বলো, তাহলে আমরা যা বলব, তুমি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাই বলবে। না হলে তোমাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলব।”
বিচারিক নিষ্ক্রিয়তা ও সহযোগিতা:
একাধিক ভুক্তভোগীর বক্তব্য থেকে জানা গেছে, ম্যাজিস্ট্রেটরা স্বীকারোক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া যাচাই-বাছাই করেননি। বরং নির্যাতনকারী সংস্থাগুলো ভুক্তভোগীদের সরাসরি আদালতে হাজির করিয়ে রিমান্ড মঞ্জুর করে নিয়েছেন, যেখানে আসামিদের কথা বলার সুযোগই দেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটরা কেবল স্বাক্ষর নেওয়ার কাজ করেছেন, তদন্ত বা জবাবদিহিতার সুযোগ ছাড়াই।
কমিশন তাদের পর্যালোচনায় দেখেছে, ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনের আওতায়, যার মধ্যে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে (১৯৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা)। এরপরই রয়েছে ১৮৮৪ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইন (৫১ জন) ও ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন (৪৩ জন)।
‘স্ক্রিপ্টেড’ অভিযোগপত্র এবং বিচারবহির্ভূত অভ্যাস:
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারি কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ফৌজদারি আইনের আওতায় গঠিত অভিযোগপত্রগুলো সময়, স্থান ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নির্বিশেষে প্রায় একই রকম দেখা যায়। অপরিষ্কার ভাষা, পুনরাবৃত্ত অভিযোগ এবং কৃত্রিমভাবে সাজানো ব্যাখ্যা এসব অভিযোগের বৈশিষ্ট্য। এতে প্রমাণ যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে গিয়ে মতপ্রকাশ, প্রতিবাদ ও আদর্শগত ভিন্নমতকে ‘জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো।
পুলিশি অভিযোগপত্রে ‘গোপন গোয়েন্দা তথ্য’ এবং ‘পালানোর চেষ্টা’ প্রায়শই অভিন্ন অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে “দ্রুত স্বীকারোক্তি” পাওয়া যায়, যা বাস্তবিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অবাস্তব বলে অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি, প্রচুর ইসলামিক ও জিহাদী গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের উল্লেখ করে সেগুলোকে “সন্ত্রাসী মনোভাবের প্রমাণ” হিসেবে তুলে ধরা হতো, যা প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড অভিযোগের ইঙ্গিত দেয়।
আদালতের ওপর প্রভাব ও বিচার ব্যবস্থার সংকট:
২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার এক প্রকার দমনমূলক যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের ৭৯৪টি মামলা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মাত্র ৫২টিতে দণ্ডাদেশ প্রদান করা হয়েছে, অর্থাৎ মাত্র ৭% সাজাপ্রাপ্তি এবং ৯৩% মামলা খালাস। এটি প্রমাণ করে, এসব মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রমাণের মান সন্দেহাতীতভাবে দুর্বল ছিল।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার প্রবণতাও স্পষ্ট। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দল ও তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর ও বিরোধী দলগুলোর সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির সময়েও মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটি মামলার গড় খরচ প্রায় ৭ লাখ টাকা, যা দেশের গড় পরিবারের দুই থেকে পাঁচ বছরের আয়ের সমান। এর ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক দুর্দশা যুক্ত হয়েছে।
কমিশন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, এ ধরনের বিচারব্যবস্থার অপব্যবহার দীর্ঘদিন চলতে থাকলে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণ এবং আইনের শাসন দুর্বল হবে। তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যাতে বিচার ব্যবস্থা তার ন্যায়বিচারের আদর্শে ফিরে আসতে পারে এবং কারো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষিত হয়।