সমতট ডেস্ক।। রাজধানীতে বেপরোয়া ছিনতাইকারীরা। প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। ছিনতাই করতে গিয়ে কখনো কখনো ঘটছে খুন-খারাবিও। ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। ঈদকে টার্গেট করে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় বেপরোয়া ছিনতাইকারী-অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা।
ব্যাংকপাড়া, শপিংমল এলাকায় ওঁৎপেতে থাকে তারা। কখনো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে, কখনো হঠাৎ ছোঁ মেরে ব্যাগ, মোবাইলফোন নিয়ে যায়। সকালের ফাঁকা রাস্তায় ও সন্ধ্যার পর নির্জন সড়কে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছিনতাইকারীরা।
ছিনতাইকারীরা অনেক সময় অজ্ঞানপার্টির ভূমিকা নেয়। চেতনাশকের মাধ্যমে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নেয়। ছিনতাইকারীদের কিছু চক্র ছদ্মাবেশে এই অপকর্ম করে। বাস বা মাইক্রোবাসের চালক, চালকের সহযোগী হিসেবে যাত্রী তোলে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয় তারা।
গতকাল মঙ্গলবার বিশেষ অভিযানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চুরি-ছিনতাই মোবাইল সিন্ডিকেট চক্রের মূলহোতাসহ ৩১ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এদের মধ্যে মলমপার্টি এবং অজ্ঞানপার্টির সদস্যও রয়েছে। তাদের কাছ থেকে ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি (আইএমইআই) নম্বর পরিবর্তন করার বিভিন্ন সরঞ্জামাদিসহ এক হাজারের বেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দেশি-বিদেশি মোবাইল ফোন, ট্যাব ও ল্যাপটপ জব্দ করা হয়েছে।
শুধু তাই নয়, বিপুল পরিমাণ মোবাইল ফোন, প্যাথেডিন ইনজেকশন, বিষাক্ত মলম এবং দেশীয় অস্ত্র তার আগের দিন সোমবার ঢাকা ও নরসিংদী থেকে ছিনতাইকারী চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। তারপরও রাজধানী ও তার আশপাশের গুরুত্বপুর্ন সড়কে লঞ্চ ঘাট, বাস টার্মিনাল ও রেল ষ্টেশনের পাশে ছিনতাই এবং অজ্ঞানপার্টিও তৎপরতা কমছে না।
রাজধানীতে গত ২৪ ঘন্টায় গ্রেফতাররা হচ্ছে, আল মামুন (২৮), রাকিব (২৭), জাহাঙ্গীর (৬৬), ইকবাল (৫০), মোখলেছুর রহমান (৩৮), বিল্লাল মিয়া (৪০), বিল্লাল (২৭), রাকিব (২৩), মাইনু (২১), জনি (২০), স্বপন (৫০), সালাউদ্দিন আহম্মেদ (৩৫), মোশারফ (৪৫), মেহেদী হাসান রাজু (২৪), জুয়েল (৪০), জুম্মুন (২৮), রকিবুল ইসলাম (৩১), নজরুল (৩০), পারভেজ (৩৮), ইউসুফ বেপারী (৪২), ইউসুফ দেওয়ান (৩৫), রুবেল মোল্লা (৩১), রুবেল দেওয়ান (৩০), জাফর (৪৮), নাছির উদ্দিন ওরফে পিন্টু (৩১), আনছার ঢালী ওরফে ডালিম হোসেন (৫২),হালিম সরদার (৫২), শাহীন শেখ (৩১), মোহাম্মদ আলী (৫৫), সবুজ (২৮) ও আবুল হোসেন (৬১)। এসময় তাদের কাছ থেকে ৩০টি ট্যাব, ৭১৭টি স্মার্টফোন, ৭৯৩টি বাটন মোবাইল, ২৮টি ল্যাপটপ ও নগদ ৫৫ হাজার ৬৪৭ টাকা জব্দ করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সারাবেলাকে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, অভিযানে গুলিস্তান এলাকার চোরাকারবারি চক্রের মূলহোতা রাকিবসহ তার চার সহযোগী, পল্টন এলাকার চোরাকারবারী চক্রের মূলহোতা বিল্লাল হোসেনসহ তার ছয় সহযোগী, রমনা এলাকার চোরাকারবারী চক্রের মূলহোতা পারভেজসহ তার ছয় সহযোগী, শাহবাগ এলাকার চোরাকারবারী চক্রের মূলহোতা নাছির উদ্দিন ওরফে পিন্টুসহ তার ছয় সহযোগী, মতিঝিল এলাকার চোরাকারবারী চক্রের মূলহোতা মো. ইউসুফ বেপারীসহ তার চার সহযোগীসহ মোট ৩১ জন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। তারা মূলত ছিনতাই ও চোরাইকৃত মোবাইল ফোন অল্পদামে কিনে আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে সুযোগ বুঝে বেশি দামে বিক্রি করতো।
অপরদিকে নরসিংদী থেকে গ্রেফতাররা হচ্ছে, গাড়িচালক হিরু মোল্লা, নিজাম উদ্দিন, গাড়িচালক মো. জাকির হোসেন ও দোকানদার মো. নজরুল ইসলাম এবং আবদুল বারেক। জিজ্ঞাসাবাদে দলনেতা বারেক স্বীকার করেছে, তারা মাইক্রোবাস নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রী উঠায়। টার্গেটকৃত দুই-একজন যাত্রী নিয়েই গন্তব্যের দিকে যাত্রা করে। নির্জন স্থানে নিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জিম্মি করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়।
ঈদ উপলক্ষে মাঠে নেমেছিল এই চক্রের সদস্যরা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মোড়, ফার্মগেট, বিমানবন্দর, আবদুল্লাহপুর এলাকায় অবস্থান নেয় এই চক্রের সদস্যরা।
ডিবির কাছে আবদুল বারেক স্বীকার করেছে, খেলনা পিস্তল দেখিয়েই জিম্মি করা হতো টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে। তাছাড়া গাড়িতে বিশেষ কৌশলে রাখা হতো ধারালো অস্ত্র। জিম্মি করে এটিএম কার্ড ও পিন নম্বর নিয়ে টাকা উত্তোলন করে চক্রের সদস্যরা। কার্ড না থাকলে মারধর করে, হত্যার হুমকি দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিকাশে টাকা আদায় করা হয়।
ডিএমপির ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ সংবাদ সারাবেলাকে জানান, চক্রটি দীর্ঘদিন থেকেই ছিনতাই, ডাকাতি করছিল। ঈদ উপলক্ষে এসব চক্রের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠে।
গত শনিবার কাওরানাবাজার দিয়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন বেসরকারি অফিসে কর্মরত হাসান জাবেদ। তিনি জানান, কাওরানবাজার মসজিদের পাশে তখন ভিড়, যানজট। হঠাৎ মনে হলো ব্যাকপ্যাকের জিপার কেউ খুলছে। পেছনে তাকিয়ে দেখেন জিপার খোলা। মানিব্যাগ নেই। দুজন কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। আর পাশের রিকশায় পা রাখার জায়গায় পরে রয়েছে মানিব্যাগ। রিকশাচালকও একবাক্যে বলে দিলেন ওই কিশোররা এটি ফেলে রেখেছে। তারপর দ্রুত তারা পালিয়ে যায়।
ছিনতাইয়ের হট স্পট গুলিস্তান, মতিঝিল, কাপ্তানবাজার, বংশাল এলাকা। এসব এলাকাতেও শতাধিক ছিনতাইকারী রয়েছে। এছাড়াও মিরপুরে, বাউনিয়াবাঁধ, তুরাগ নদীল তীরবর্তী এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। অর্ধশতাধিক ছিনতাইকারী রয়েছে ওই এলাকায়।
গুলশান, বাড্ডা এলাকায় অর্ধশত ছিনতাইকারী রয়েছে। এই চক্রটি বাড্ডা, নতুনবাজার, মহাখালী এলাকায় ছিনতাই বেশি করে থাকে। উত্তরার দক্ষিণখান, আজমপুর, আবদুল্লাহপুর এলাকায় রয়েছে প্রায় ৬০ জনের বেশ কয়েক চক্র। এই চক্রের সদস্যরা টঙ্গী, গাজীপুর এলাকাতেও ছিনতাই করে থাকে। এছাড়াও বংশাল, বাবুবাজার, চকবাজার এলাকায় রয়েছে কয়েকটি চক্র। ছিনতাইকারীদের বেশির ভাগই বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। জামিনে বের হয়ে আবারো একইভাবে চক্রের সঙ্গে মিশে চুরি-ছিনতাই করছে।
র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঈদকে সামনে রেখে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীরা রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলিতে ওতপেতে থাকে। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারা ধারালো অস্ত্র প্রদর্শন করে সর্বস্ব লুটে নেয়। ইতোমধ্যে ছিনতাইকারী চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।