সমতট ডেস্ক।।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর মাস! লগি-বৈঠা আন্দোলনে মানুষ মেরে লাশের ওপর নৃত্য করেছিল সেদিন। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার তখন বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট তখন তুমুল আন্দোলন করছে। ঢাকার পল্টন-বায়তুল মোকাররম এলাকায় জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে সেদিন ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্যে অস্ত্র তুলে গুলি এবং মানুষ পিটিয়ে মারার ঘটনা গভীর আলোড়ন তৈরি করেছিল। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রকাশ্যে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে জামায়াত-শিবিরের ৬ নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়।
জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব থেকে শুরু করে সারাবিশ্বে ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। শুধু হত্যাই নয়, মৃত লাশের উপর নৃত্য করার দৃশ্যও প্রত্যক্ষ করে বিশ্ববাসী। এটা শুধুমাত্র নৃশংস হত্যাকান্ডই নয়, এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথ চলা ব্যাহত হয়, ঘটে ব্যত্যয়। সর্বত্র বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে আসার শ্লোগান দেখা গেলেও এই নির্মম ঘটনার বিচার হতে দেখেনি দেশবাসী। আটাশ অক্টোবর বাংলাদেশের ইতিহাসে মানবতাবিরোধী অপরাধের এক কলংকজনক দিবস।
লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে এসে প্রতিপক্ষকে দমনের ঘোষণা ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের। এ ঘটনায় পল্টন ও শাহবাগ থানায় পৃথক ৫টি মামলা হয়। পল্টন থানায় করা পাল্টাপাল্টি দু’টি মামলার একটি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই প্রত্যাহার করা হয়। ক্ষমতাসীন ১৪ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা অন্য মামলাগুলোও পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
সে সব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা আসামি ছিলেন। অপর দিকে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের আসামি করে যে মামলাটি হয়েছিল তা উচ্চ আদালত স্থগিত করে রেখেছেন।
উল্লেখ্য, মাওলানা নিজামীর বক্তব্য শুরু হওয়ার ৪/৫ মিনিট পর ৪টা ৪৩ মিনিটে পল্টন মোড়ে উত্তেজনা দেখা যায়। এ সময় নির্মাণাধীন র্যাংগস টাওয়ারের (বাসস ভবনের পূর্ব পাশের বিল্ডিং) ছাদ থেকে সমাবেশ লক্ষ্য করে ১০/১২টি বোমা ও প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে দফায় দফায় গুলী ছুঁড়ে সন্ত্রাসীরা।
এ সময় পুলিশ নিজেদের নিরাপদ স্থানে হটিয়ে নেয়। একদিকে ভবনের ছাদ থেকে বৃষ্টির মতো বোমা বর্ষণ করতে থাকে। অপরদিকে পল্টন মোড় থেকে গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা সমাবেশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সময় জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা তৈরি করে মানব ঢাল।
আওয়ামী অস্ত্রধারীদের ছোঁড়া গুলী মাথায়বিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়েন জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমান ও জুরাইনের জামায়াত কর্মী জসিম উদ্দিন। এ ঘটনায় জামায়াত ও শিবিরের ৬ জন নেতাকর্মী নিহত হন এবং আহত হন সহস্রাধিক।
মাগরিবের আজানের পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসে যখন বিডিআর পল্টন মোড়ে অবস্থান নেয়। এর আগে সমাবেশের কোনো বক্তাই উত্তেজনাকর বক্তব্য দেননি, আক্রমণাত্মক কথাও বলেননি কেউ।
সে সময় সারাদেশে হত্যা ও নৈরাজ্য চলে। ২৭ অক্টোবর গাজীপুরে হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জামায়াতে ইসলামী গাজীপুর জেলার প্রচার সম্পাদক, জেলা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি মুহাম্মদ রুহুল আমীনকে। ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর ঢাকাসহ সারাদেশে জামায়াত-শিবিরসহ চারদলীয় জোটের ৫৪ জন নেতাকর্মী মারা যায়। আহত হয়েছে ৫ সহস্রাধিক জামায়াত, শিবির, বিএনপি নেতাকর্মী, সাংবাদিক, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষ। এ পৈশাচিকতা ও বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পায়নি মায়ের কোলের শিশু, নারী, বৃদ্ধ এবং নিরীহ জনগণও। তাদের তিনদিনের ধ্বংসলীলায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।