প্রযুক্তির ব্যবহার প্রতিনিয়তই বদলে দিচ্ছে পৃথিবীকে। জীবন যাপনকে অতীতের থেকে সহজ ও আরামদায়ক করছে প্রযুক্তির পরশ পাথরের ছোঁয়া। বিশেষ করে চিকিৎসায় প্রযুক্তির ব্যবহার অতীতের যে কোনো সময়ের থেকে স্বাস্থ্যসেবাকে করেছে জটিলতা ও ঝামেলামুক্ত।
স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক ধরনের রোগ ও উপসর্গের ব্যাপারে পাওয়া যাচ্ছে আগাম আভাস। যার জেরে রোগ জটিল রূপ ধারণ করার আগেই তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারছেন রোগীরা। এমনকি রোগ সৃষ্টি হওয়ার আগেই ধারণা করা যাচ্ছে রোগের কারণ ও উৎস সম্পর্কে। যার জেরে সহজেই জটিল অবস্থায় পৌঁছানোর আগেই চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করতে পারছেন রোগীরা। দ্রুত আরোগ্য লাভের মাধ্যমে রোগী ফিরতে পারছেন তার স্বাভাবিক জীবনে।
কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে বদলে দিচ্ছে প্রযুক্তির উদ্ভাবন?
স্বাস্থ্যসেবায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রসারের ফলে এখন রোগীরা সহজেই বিশ্বের সর্বশেষ চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারছেন।বর্তমান বিশ্বে গণমানুষের স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তি বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি কতটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে কোভিডকালীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। সে সময় লকডাউনের কারণে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মানুষকে বাধ্য হয়েই ঘরেবন্দি থাকতে হয় দীর্ঘদিন। তবে প্রযুক্তির বদৌলতে ঘরে বন্দি থাকার সময় সহজেই স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ গ্রহণ সম্ভব হয় তাদের জন্য। বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ এর সহায়তায় রোগীরা ঘরে বসেই বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসা পরামর্শ লাভ করতে পেরেছেন। এর মাধ্যমে কোভিডের সময় হাসপাতালগুলোতে নন কোভিড রোগীদের বাড়তি চাপ পড়েনি। যে কারণে হাসপাতালগুলো সহজেই তাদের চিকিৎসা সেবার সীমিত অবকাঠামোর প্রায় পুরোটাই কোভিড আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত রাখতে পেরেছে।
কোভিডের অভিজ্ঞতা থেকে আরও দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে রোগী ও চিকিৎসক-হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষ করে ভিডিও কল করার সুবিধা সংবলিত অ্যাপসগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎকরা সহজেই দূরে থেকেও তাদের রোগীদের সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখতে পেরেছেন। যা তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়ার বিষয়টিকে আরও সহজ করে তোলে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যবর্তী দূরত্বের ক্ষেত্রে এমনকি ঘুচে গেছে সীমান্তরেখা পর্যন্ত। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের এক দেশ থেকে আরেক দেশে থাকা রোগীর পরিস্থিতি সম্পর্কে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে সক্ষম হয়েছেন চিকিৎসকরা।
রোগীদের তথ্য জানাচ্ছে ডিজিটাল মেডিকেল রেকর্ড
স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তির আরেকটি যুগান্তকারী সংযোজন হলো ইলেক্ট্রনিক হেলথ রেকর্ডস বা ইএইচআর পদ্ধতি। এর মাধ্যমে একজন রোগীর প্রায় সব ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ফলে ওই রোগী যেখানেই যে চিকিৎসকের কাছেই চিকিৎসা নেন না কেন, তার অতীতের রোগ সংক্রান্ত সব তথ্য চলে যাচ্ছে তার বর্তমান চিকিৎসকের কাছে। এর ফলে ওই রোগীর রোগ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জেনেশুনে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন চিকিৎসকরা।
ইএইচআর পদ্ধতিতে সংরক্ষিত হয় রোগীর প্রেসক্রিপশন, তার বিভিন্ন ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট, অতীতের অস্ত্রোপচার, হাসপাতালে অবস্থানের রেকর্ডসহ তিনি কী কী ওষুধ খেয়েছেন তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ। একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবায় যথাযথভাবে এই ইএইচআর পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটানোর মাধ্যমে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা খাতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জাপান।
ডিজিটাল রেকর্ডের মাধ্যমে একজন রোগীর চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং ল্যাব টেকনিশিয়ানদের মধ্যেও প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন সম্ভব। এর মাধ্যমে চিকিৎসায় অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা কমিয়ে আনার মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যয়ে সাশ্রয় করার পাশাপাশি চিকিৎসায় অবহেলাও হ্রাস করার সম্ভব। ইএইচআর পদ্ধতির প্রয়োগের মাধ্যমে একজন রোগীর রোগ নির্ণয় অপেক্ষাকৃত কম সময়েই সম্ভব হয়, এবং তাদের রোগ ও চিকিৎসার বিভিন্ন পর্যয়ের রেকর্ড সংরক্ষণ করাও সহজসাধ্য। এই পদ্ধতি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের চিকিৎসা দেয়ার কাজকে সহজ করে এবং তাদের ভুল করার হার কমিয়ে আনার মাধ্যমে রোগীদের জীবনকে আরও সহজ করে তোলে।
চিকিৎসা প্রযুক্তির প্রসারে বিগ ডাটা
বর্তমান কালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন হচ্ছে। প্রতিনিয়তই ঘটছে নিত্য নতুন উদ্ভাবন। আর এগুলোর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে বিপুল সংখ্যক তথ্য ধরে রাখার উপযুক্ত পরিকাঠামো। এক্ষেত্রে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বিগ ডাটা। বিগ ডাটার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা অল্প সময়েই অনেক বেশি সংখ্যক তথ্যকে সহজেই সংরক্ষণ করতে পারছেন। এক সঙ্গে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্লাউড স্টোরেজ পদ্ধতি। তথ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্টরা সহজেই চিকিৎসা সেবায় নতুন নতুন প্রযুক্তির বিকাশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পারছেন, এবং প্রয়োজন অনুযায়ী রোগীদের ওপর সেই জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাতে পারছেন। বিভিন্ন রোগ, উপসর্গ ও রোগসৃষ্টিকারী উপাদান সম্পর্কে বিশ্লেষকরা গবেষণা করতে পারছেন এবং সম্ভাব্য বিভিন্ন মহামারি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে পারছেন। পাশাপাশি এসব মহামারির প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর উপায় সম্পর্কেও জানাতে পারছেন।
মানুষকে রোগ সম্পর্কে সচেতন করছে তথ্যপ্রযুক্তি
বর্তমানে বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতেই রয়েছে মোবাইল ফোন কিংবা স্মার্টফোন। যেখানে রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ। এর মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্যসেবার সর্বশেষ বিভিন্ন আপডেট জানতে পারছেন সাধারণ মানুষ। ফলে তাদের বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ছে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার প্রবণতা। স্বাস্থ্যসেবায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষ। তারা সহজেই বিভিন্ন রোগের ব্যাপারে তথ্য সহ স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত যে কোনো প্রয়োজনে দূরে থাকা চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হচ্ছেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন। এ ছাড়া রোগীদের সামনে একাধিক চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণেরও সুযোগ তৈরি করছে প্রযুক্তি ও যোগাযোগ। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরে থাকা চিকিৎসকদের থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতে পারছেন তারা। এর মাধ্যমে রোগ ও আরোগ্যের উপায় সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে পারছেন রোগীরা। এমনকি ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে এক দেশের চিকিৎসকরা আরেক দেশে অবস্থানরত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের থেকে অস্ত্রোপচারের সময় প্রয়োজনীয় পরামর্শও গ্রহণ করতে পারছেন।
স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও মেশিন লার্নিং বিশ্বের প্রচলিত প্রায় সব খাতেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করছে, যার বাইরে নেই স্বাস্থ্যসেবা খাতও। স্বাস্থ্যসেবায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। ওষুধ ও ভ্যাক্সিন তৈরির গবেষণা থেকে শুরু করে উৎপাদন, রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি ও নিরাময় থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রত্যেকটি ধাপেই শুরু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। এর মাধ্যমে বৃদ্ধি পাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা খাতের সার্বিক কর্মদক্ষতা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোগের কাঠামো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য দেয়ার মাধ্যমে এর ভবিষ্যত বিস্তার সম্পর্কে আগাম তথ্য দিতে পারছে। এর মাধ্যমে রোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ আরও সহজ হচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তার উন্নত অ্যালগরিদম ব্যবহার করে মেডিকেল ইমেজিং ডাটাকে আরও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী রোগকে প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করা সম্ভব হয়, প্রচলিত পদ্ধতির থেকে অনেক কম খরচে।
এভাবে ক্যানসারসহ অন্যান্য জটিল রোগের লক্ষণ সম্পর্কে আগাম সতর্কবাণী পাওয়ার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছেন লাখ লাখ রোগী। এতে চিকিৎসকরা রোগীর চিকিৎসায় হাতে পাচ্ছেন মূল্যবান সময়। ফলে বাড়ছে রোগীদের প্রাণ বাঁচার হার।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে সরাসরি উপকৃত হচ্ছে ওষুধ ও প্রতিষেধকের গবেষণা ও উৎপাদন খাত। বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে গবেষণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিগ ডাটা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো আগের থেকে কম সময়ে, কম খরচে ও কম শ্রম ব্যয় করে নতুন ওষুধ ও প্রতিষেধকের উদ্ভাবন ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিপুল অর্থ সাশ্রয়ের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে ওষুধের দামকেও কমিয়ে রাখা।