কম খরচে টেস্ট টিউবের মাধ্যমে বন্ধ্যা মা-বাবার সন্তান জন্মদানে মফস্বল পর্যায়ে ব্যাপক সফলতা দেখিয়ে যাচ্ছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল দীপশিখা ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড কাউন্সেলিং সেন্টার। সহজলভ্য হয়ে ওঠায় এখন প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক মা-বাবা এ পদ্ধতি ব্যবহারে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। আইভিএফ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিবাস চন্দ্র পালের সেন্টার থেকে চিকিৎসা নিয়ে এ পর্যন্ত ২৫ জন বন্ধ্যা মা-বাবা সন্তানের মুখ দেখেছেন। গত সপ্তাহ দশ দিনে তিনজন মা যমজসহ পাঁচটি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এমন সফলতায় মা-বাবাসহ পরিবারের সবাই উচ্ছ্বসিত। আর মা-সন্তানও সুস্থ রয়েছেন।
সম্প্রতি শ্রীমঙ্গল দীপশিখা ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড কাউন্সিলিং সেন্টারে গেলে দেখা যায়, ঢাকার গাজীপুরের আয়শা খাতুন নামে এক মা তার যমজ শিশু কোলে নিয়ে বসে আছেন। আর নবজাতক শিশু দুটির কান্নার শব্দে পুরো ঘর মেতে আছে। এমন প্রত্যাশার প্রাপ্তির কান্না শুনে মা-ও আবেগে আপ্লুত। কারণ, দীর্ঘ নয় বছর পর মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে মায়ের মুখেও আত্মতৃপ্তির হাসি।
জানা যায়, ঢাকার গাজীপুরের শহিদুল ইসলামের স্ত্রী আয়শা খাতুনের সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা ছিল না। নানান চিকিৎসা নিয়েও কোনো কাজ হয়নি। পরে খোঁজ পেয়ে দীপশিখা ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড কাউন্সেলিং সেন্টারে চিকিৎসা নেন। অবশেষে দীর্ঘ নয় বছর পর টেস্টটিউব পদ্ধতিতে যমজ শিশুর জন্ম দেন তিনি।
শুধু-যে আয়শা খাতুন একাই টেস্টটিউব পদ্ধতিতে শিশু জন্ম দিয়েছেন তা কিন্তু নয়; তার মতো শ্রীমঙ্গল ভুরভুরিয়া চা বাগান বস্তির মনি-রজক এবং কমলগঞ্জ মনিপুরী পাড়ার সুস্মিতাও রয়েছেন। সপ্তাহ-দশ দিনের ব্যবধানে তারা মা হয়েছেন। মা-সন্তান সবাই সুস্থ রয়েছেন।
উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসক নিবাস চন্দ্র পালের একক প্রচেষ্টায় বন্ধ্যা নারীরা সন্তান জন্মদানে সক্ষমতা ফিরে পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চিকিৎসা নিতে আসা নিঃসন্তান দম্পতিরা আশাবাদী হয়ে উঠছেন।
গাজীপুরের শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একটি সন্তানের জন্য আমাদের চেষ্টার শেষ ছিল না। সব সময় আল্লাহর কাছে একটি সন্তানের জন্য দোয়া করতাম। বিশ্বাস ছিল আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করবেন। আর এদিকে দিনে দিনে বিজ্ঞান অগ্রগামী হচ্ছে। তো একদিন ইউটিউবের কল্যাণে ডাক্তার নিবাস চন্দ্র পালের বিষয়ে জানতে পারলাম। ভাবলাম তার চিকিৎসা নিয়ে আরেকবার চেষ্টা করা যাক। অবশেষে আমি বাবা হলাম আর আমার স্ত্রী মা হলেন।’
ডাক্তার নিবাস চন্দ্র পাল মূলত একজন গাইনি স্পেসালিস্ট। ভারতের মহারাষ্ট্রের আওরঙ্গবাদে ইনফার্টিলিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে এসে ছয় বছর আগে শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহরে গড়ে তোলেন সিলেট বিভাগের একমাত্র স্প্যাশালাইজড দীপশিখা ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড কাউন্সেলিং সেন্টার। ২০২১ সাল থেকে টেস্টটিউব শিশু জন্মদান কার্যক্রম শুরু করেন। ২০২২ সালে প্রথম টেস্টটিউব পদ্ধতিতে শিশুর জন্ম হয় তার এ সেন্টারে। এরই মধ্যে প্রান্তিক পর্যায়ের লোকজনও এ পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান জন্মদানে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এ পর্যন্ত ১২৫ জন নিঃসন্তান নারীকে আইভিএফ ভ্রূণ ট্রান্সফার করা হয়। এতে সন্তান জন্ম দেন ২৫ জন নারী। আর সন্তানসম্ভবা ৩৯ জন নারী।
ডাক্তার নিবাস চন্দ্র পাল বলেন, ‘চিকিৎসার শুরুর দিকে আমি সাধারণত গাইনি বিষয়ক রোগ নির্ণয় ও সে রোগের চিকিৎসা করতাম। একপর্যায়ে দেখলাম- নিঃসন্তান দম্পতিরা এসব চিকিৎসায় সন্তানসম্ভবা হতে পারছেন না। এ নিয়ে পরিবারগুলোতে চরম অশান্তি দেখা দেয়। আমি নিজ চোখে দেখেছি, সন্তান জন্ম দিতে না পারা স্ত্রীকে স্বামী-শাশুড়ি ও পুরো পরিবার মিলে নানাভাবে অত্যাচার করতে। এটি একটি সামাজিক ব্যাধিতে রুপ নিয়েছে। এটা আমাকে ব্যথিত করতো। সে ব্যথা থেকে সাধারণ গাইনি চিকিৎসার পরিবর্তে ইনফার্টিলিটি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হই। প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৮ সাল থেকে আমার এ যাত্রায় শুরু। আমার এ প্রতিষ্ঠানে আধুনিক সর্বশেষ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে।’
এ ছাড়া ২০১৬ সাল থেকে আইইউআই পদ্ধতিতে ৭৯২ জন দম্পতি চিকিৎসা নিয়েছেন। এতেও সফলতা পান ১৩৫ জন নারী। এখন পর্যন্ত এ পদ্ধতিতে সন্তানসম্ভবা আছেন আরও ৩৫ জন। আর অন্যান্য জটিলতায় বাকিরা সন্তান জন্ম দিতে পারেননি। তবে এর সফলতার বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ডাক্তার নিবাস চন্দ্র পাল।
ডাক্তার নিবাস চন্দ্র পাল টেস্টটিউব পদ্ধতির সফলতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে আইভিএফ ও আইইউআই কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্য একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা নিয়েছি। এটি হচ্ছে পিজিডি। অথাৎ পিন প্ল্যানটেশন ডমেট ডায়াগনেস্টি বা টেস্টিং ল্যাব করা। আশা করছি এটাতেও সফলতা পাওয়া যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেয়েদের জরায়ুতে অ্যাডোনোমাইসিস নামের এক প্রকার রোগ হয়ে থাকে। এতে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। এ রোগ নিরাময়ের জন্যে ভারতে একাধিক হাইপো সেন্টার গড়ে উঠেছে। ননসার্জিকেলি চিকিৎসা দিতে শ্রীমঙ্গলেও এরকম একটি হাইপো সেন্টার গড়ার স্বপ্ন আছে।’
এদিকে ডাক্তার নিবাসের এ কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তায় রয়েছেন তার স্ত্রী এমব্রায়োলজিস্ট দীপশিখা ধর। তিনি সিমেন্স এনালাইসিসসহ পুরো ল্যাবের দায়িত্বে রয়েছেন।
দীপশিখা ধর বলেন, ‘মফস্বল শহরে এ কার্যক্রম চালাতে নানা রকম সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়েছে। সব প্রতিবন্ধকতা উতরে গিয়ে আমরা টেস্ট টিউব শিশুর জন্মদানে এ পর্যন্ত ব্যাপক সফলতা অর্জন করতে পেরেছি। আর কিছু হোক বা না-হোক নিঃসন্তান মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর নির্মল আনন্দ আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে পাচ্ছি।’
মৌলভীবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ দীপশিখা সেন্টারের এ কার্যক্রমকে সিলেট বিভাগের একমাত্র ইনফার্টিলিটি সেন্টার জানিয়ে বলেন, ‘নিঃসন্তান দম্পতির জন্য এটি অত্যন্ত ভালো কাজ। এবং ডাক্তার নিবাস এ কাজে এরইমধ্যে ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছেন।’
নিঃসন্তান মায়ের ভ্রূণ ট্রান্সফার প্রক্রিয়া শুরুর ৯ মাসপর টেস্টটিউব শিশুর জন্ম হয়। দীপশিখায় টেস্টটিউব প্রক্রিয়াতে আরও ৩৯ এবং আই.ইউ.আই প্রক্রিয়াতে ৩৫ জন নারী মা হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।