সমতট ডেস্ক: স্বাস্থ্যসচেতনতার কথা চিন্তা করে আমরা অনেকেই ভাজাপোড়া বা তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে খাইও। আবার কেউ প্রায় প্রতিদিনই ভাজাপোড়া মুখরোচক খাবার স্বাচ্ছন্দ্যেই খাই। বাংলাদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে বেশ কিছু ভাজাপোড়া খাবার।
বিশেষ করে আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু, শিঙাড়া, সমুচা, পুরি, ছোলা ইত্যাদি। মুখরোচক এই খাবারগুলো রাজধানীর ফুটপাতের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, দুপুরের খাবার হিসেবে অনেকেই খাচ্ছেন। কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, পান্থপথের ফুটপাতে প্রতিদিনই দেখা যায়, দুপুরে ভাতের বদলে অসংখ্য মানুষ ভাজাপোড়া খাবার খাচ্ছেন।
কিন্তু যারা এভাবে নিয়মিত ফুটপাতের ভাজাপোড়া খাবার খাচ্ছেন, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর তাই এ বিষয়ে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট ডা. মোসাব্বির আহমেদ খানের কাছে জানতে চেয়েছি। তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘ভাজাপোড়া রাস্তায় যেগুলো পাওয়া যায়, এগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, হাইজিন মেইনটেইন করে বানানো হয় কি না, তা আমরা ভালো করে জানি না।
আর হাইজিন মেইনটেইন করে বানানো হলেও রাস্তার উপরে থাকলে খাবারে মাছি এসে বসে বা ধুলোবালি এসে পড়ে। নানাভাবেই ওই খাবারগুলো স্বাস্থ্যসম্মত থাকে না। এ কারণে বমি, পাতলা পায়খানা, ফুড পয়জনিং, আমাশয়-এই রোগগুলো হয়। তা ছাড়া বারবার একই তেলে ভাজার কারণে ফ্রি র্যাডিকেল তৈরি করে। ফ্রি র্যাডিকেলের কারণে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। শুধু তা-ই নয়, ডুবো তেলে বারবার ভাজা খাবার নিয়মিত খেলে বুক জ্বালাপোড়া করে। তা ছাড়া পাকস্থলীর এসিড নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় ওই ভাজাপোড়া খাবার। এ কারণেই মূলত এসিডিটি হয়। এভাবে দীর্ঘদিন চললে পেটে আলসারও হতে পারে।
বারবার একই তেলে ভাজা খাবারগুলো নিয়মিত খেলে শরীরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার অবনতি ঘটে। এমন হলে শরীরের রিপেয়ার সিস্টেম কুলিয়ে উঠতে পারে না। তখনই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিগুলো হয়। এর মধ্যে অন্যতম ক্যানসার, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক। তবে কিছু নিয়ম মেনে মুখরোচক এই খাবারগুলো তৈরি করলে তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার পর খুব বেশি সমস্যা হয় না বলে মনে করেন ডা. মোসাব্বির আহমেদ খান।
তিনি আরো বলেন, ‘এই খাবারগুলো উপভোগ করতে পারেন। তবে সেটা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে হতে হবে। প্রথমত, ডুবো তেলে খাবার না ভেজে কম তেলে ভেজে খাওয়া ভালো। দ্বিতীয়ত, ভালো তেলে ভাজতে হবে বেগুনি বা চপ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো অ্যাভোকাডো অয়েল। এটা ৫০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে তেলটা পোড়ার আগে। যে কারণে ফ্রি র্যাডিকেল তৈরি হয় না।
এ ছাড়া সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলে যদি কম আঁচে রান্না করা যায়, যেমন-তেল পুড়ে ধোঁয়া যেন বের না হয়। ধোঁয়া বের হওয়ার আগেই রান্না শেষ করতে পারলে ভালো। তবে যেগুলো খুব তাড়াতাড়ি পুড়ে যায়, যেমনÑসরিষার তেল, ঘি এগুলো ২০০-২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পুড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে চুলার হিট কমিয়ে-বাড়িয়ে রান্না করা যেতে পারে। এতে তেল পুড়ে ধোঁয়া বেরোনোর সম্ভাবনা কম থাকবে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে যদি রান্না করা যায়, তাহলে মাঝেমধ্যে মুখরোচক এই খাবারগুলো খেলে খুব সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু স্টিট ফুডের ক্ষেত্রে হিসাব ভিন্ন।’
স্বাস্থ্যকর দিক বিবেচনা করে বাসাবাড়িতে হয়তো নিয়ম মেনে খাওয়া সম্ভব। কিন্তু ফুটপাতে এসব নিয়ম কে মানবে? অতএব ফুটপাতে ভাজাপোড়া খেলে নানা ধরনের স্বাস্থ্যকর সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। তা ছাড়া ফুটপাতে কৃত্রিম রঙ ও রাসায়নিক ব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে। ডা. মোসাব্বির আহমেদ খান আরো বলেন, ‘অনেক স্ট্রিট ফুড বেশি তেলে ভাজা হয়, যা স্থূলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। নিয়মিত এ ধরনের খাবার খাওয়া উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে। তা ছাড়া কিছু বিক্রেতা খাবারের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য কৃত্রিম রঙ, নিম্নমানের সস এবং রাসায়নিক সংরক্ষণকারী পদার্থ ব্যবহার করেন।
এসব উপাদান দীর্ঘ মেয়াদে ক্যানসারসহ নানা রোগের কারণ হতে পারে।’ ফুটপাতের ভাজাপোড়া খাবারের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে আমরা লিভার ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মইনুদ্দিন আহমেদের সঙ্গেও কথা বলি। তিনি বর্তমানে কুড়িগ্রাম সরকারি জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত আছেন। ডা. মইনুদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘শিঙাড়া, সমুচা, চপ, ফ্রায়েড চিকেন-এসব ভাজাপোড়া খাবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কারণ এতে সাধারণত নিম্নমানের তেল ও বারবার ব্যবহৃত তেল ব্যবহার করা হয়।
দীর্ঘ সময় ধরে একই তেলে ভাজা হলে এতে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়, যা হার্টের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার পেটে গ্যাস, হজমের সমস্যা, এসিডিটি, GERD এবং পেপটিক আলসার ডিজিজের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া ফাস্টফুড অতিমাত্রায় খেলে ফ্যাটিলিভার, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়তে পারে। বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে হজম ক্ষমতা কম থাকায় রাস্তার খাবারে ব্যবহৃত অতিরিক্ত মসলা, তৈলাক্ত উপাদান এবং বাসি খাবার থেকে গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, GERD, পেপটিক আলসার এবং হজমজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।’
দুজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেল, যখন-তখন ফুটপাতে ভাজাপোড়া খাওয়া মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আর নিয়মিত এগুলো খেলে বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। তবে মুখরোচক এই খাবারগুলো খেতে ইচ্ছে করলে নিয়ম মেনে বাসাবাড়িতে তৈরি করা যেতে পারে। এতে স্বাস্থ্যকর ঝুঁকি খুব একটা থাকবে না।