মো রকিবুল হাসান ।।
ভারী বর্ষণ ও ভারতের ত্রিপুরা থেকে আসা ঢলে দেশের ১১টি জেলা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। তবে ইতিবাচক খবর হলো, বানের পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে। টানা পাঁচ দিন ধরে পানির নিচে থাকা জনপদগুলো এখন বন্যার ক্ষতচিহ্ন নিয়ে জেগে উঠছে। কিন্তু এখনও ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। এ অঞ্চলে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও ওষুধ। দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে, এবং সেসব এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। শনিবার রাতে আবারও বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম ও খুলনার কিছু নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত বন্যায় ১৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও, রোববার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় নতুন কোনো মৃত্যুর তথ্য জানাতে পারেনি। তবে ফেনী ও কুমিল্লায় আরও পাঁচজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
রোববার ফেনী শহরের অধিকাংশ এলাকায় পানি কমে যাওয়ার ফলে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পুনরায় চালু হয়েছে। পাঁচ দিন পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে যান চলাচল শুরু হলেও ব্যাপক যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে। বন্ধ থাকা রেলপথও পুনরায় সচল হচ্ছে। ফেনীর বন্যাকবলিত মানুষের সাহায্যে রেলওয়ে রিলিফ ট্রেন চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে শহরের বাইরের অঞ্চলগুলো, বিশেষ করে ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম এখনও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। সোনাগাজী ও দাগনভূঞায়ও পানি বাড়তে শুরু করেছে। সড়ক ও ঘরবাড়ি, কিছুই অক্ষত নেই। এরই মধ্যে নতুন করে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সাপের দংশনে অনেক মানুষ আহত হয়েছেন, কিন্তু চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা নেই। ফেনীর পানিতে ডুবে থাকা হাসপাতালগুলো এখনও সচল হয়নি, ফলে রোগীরা চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন।
এসব অঞ্চলের বিপর্যস্ত মানুষদের বাঁচাতে স্বেচ্ছাসেবকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, কিন্তু নৌযানের অভাবে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য কারো কাছে নেই। ক্ষুধার্ত মানুষরা অপেক্ষা করছে, কবে তারা উদ্ধার হবে এবং খাবার পাবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যারা ঠাঁই পেয়েছেন, তারাও পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন না। নারী, শিশু এবং বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে রয়েছেন। যত দিন গড়াচ্ছে, তাদের লড়াই করার শক্তিও ক্রমশ নিঃশেষিত হচ্ছে।
এদিকে, ফেনীতে বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া বৃদ্ধ শহিদুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ফেনীর লালপোল এলাকায় অজ্ঞাত এক শিশুর লাশ পাওয়া গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় এখনও দেশের ১১টি জেলায় ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫২ লাখ ৯ হাজার ৭৯৮ জন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান জানিয়েছেন, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাচ্ছে। নতুন করে কোনো জেলা প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বন্যাদুর্গতদের জন্য ৩ হাজার ৬৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং সেখানে ৪ লাখ ১৫ হাজার ২৭৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন। সেই সঙ্গে ২২ হাজার ২৯৮টি গবাদি পশুকেও আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বন্যার্তদের চিকিৎসায় ৭৪৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে
বন্যার কারণে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। শিশু এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মধ্যে রোগের প্রকোপ বেশি। দূষিত পানি পান এবং বন্যার পানিতে চলাফেরার কারণে ডায়রিয়া, চর্মরোগ, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও চোখের প্রদাহের ঘটনা বেড়ে গেছে।
ফেনীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল পাঁচ দিন ধরে পানির নিচে থাকায় কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। চিকিৎসক এবং নার্সের অভাব প্রকট। জেলার সবচেয়ে বড় এ হাসপাতালের পাশাপাশি অন্যান্য হাসপাতালের কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। ফলে রোগে আক্রান্ত মানুষজন চিকিৎসা ছাড়াই ধুঁকছেন। তবে ১১ জেলায় কত মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য এখনও জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বন্যার পানি সরে গেলে রোগের প্রাদুর্ভাব মারাত্মকভাবে বেড়ে যেতে পারে। এজন্য এখন থেকেই সব হাসপাতাল সচল করা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধের মজুদ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
নোয়াখালী অঞ্চলের উন্নয়নকর্মী নুরুল আলম মাসুদ জানান, বন্যার কারণে শিশুমৃত্যু, সাপের দংশন এবং রাসায়নিক পানিতে মিশে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বন্যার পরবর্তী সময়ে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে। নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ডায়রিয়া, কলেরা এবং গ্যাস্ট্রিকের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া, দুর্গত এলাকার মানুষ মানসিক চাপেও আক্রান্ত হতে পারেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার ভেঙে পড়ায় ওষুধ সংকট দেখা দিতে পারে। এজন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।
ত্রাণ সংকট ও বিশুদ্ধ পানির অভাব
ফেনী সদরের মধ্যম চাড়িপুর গ্রামের বাসিন্দা আলতাব হোসেন জানান, নলকূপগুলো ডুবে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যাচ্ছে না। খাবারের পর্যাপ্ত সংস্থানও নেই। অনেকেই পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে শিশুরা ডায়রিয়ায় ভুগছে। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। খাবার স্যালাইন থাকলেও বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে।
ফেনীর সোনাগাজী নতুন করে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সোনাগাজীর বাসিন্দা আব্দুর রব জানান, তাদের বাড়ির ভেতরে কোমরপানি জমে গেছে। সুপেয় পানির অভাব এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রান্নার কোনো ব্যবস্থা নেই, অধিকাংশ মানুষ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ত্রাণও তেমন আসছে না।
সারাদেশ থেকে ত্রাণ সহায়তা মূলত পাকা সড়কের পাশের এলাকায় পৌঁছাচ্ছে। ফেনীর পরশুরাম, ছাগলনাইয়া এবং ফুলগাজীর মতো দুর্গম অঞ্চলে ত্রাণের অভাব সবচেয়ে বেশি। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে কিছু ত্রাণ ফেলা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
ফেনীতে ত্রাণ কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবক কেফায়েত শাকিল জানিয়েছেন, ফেনীর অধিকাংশ উপজেলার পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। নৌকার অভাবে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। দোকানপাটেও খাবারের সংকট রয়েছে, এবং কিছু পণ্যের দাম অত্যন্ত বেশি রাখা হচ্ছে। ১৪০০-১৫০০ টাকার গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়। সাধারণ মানুষ অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
অন্যান্য জেলার পরিস্থিতি
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী এবং রাউজানসহ হালদা নদীর আশপাশের এলাকায় বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ সোহাগ তালুকদার জানিয়েছেন, ৫০ বছরের মধ্যে এই প্রথম হালদা নদীর পানি বিপৎসীমার ১১০ সেন্টিমিটার ওপরে গিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নাজিরহাট পুরাতন সেতুর পশ্চিমে প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কুমিল্লায় বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও অনেক এলাকা এখনও জলমগ্ন। গতকালও গোমতীর পানি বিপৎসীমার ওপরে ছিল। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, ১৭ উপজেলার মধ্যে ১৪টি বন্যাকবলিত; ৮ লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি। গোমতীর বাঁধ ভাঙনের ফলে বুড়িচংয়ে আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। তিতাসে নিখোঁজ হওয়া দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া, কুমিল্লার বুড়িচংয়ের রামনগরে এক বৃদ্ধের লাশ পাওয়া গেছে।
শনিবার রাতভর বৃষ্টিতে নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আরা জানিয়েছেন, ২০ লাখ মানুষ এখনও পানিবন্দি। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলাও বন্যার পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে।
হবিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি কমতে শুরু করায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ স্পষ্ট হচ্ছে। মৌলভীবাজারের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে থাকলেও মানুষের দুর্ভোগ কাটেনি। বিশেষ করে রাজনগর, কুলাউড়া, সদর এবং কমলগঞ্জ এলাকায় বন্যায় বেশি ক্ষতি হয়েছে।
খুলনায় নতুন করে ভারী বৃষ্টির ফলে বিভিন্ন সড়ক ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ জানিয়েছেন, শনিবার রাত থেকে গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত খুলনায় মৌসুমের এক দিনে সর্বোচ্চ ৯৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ডুমুরিয়াতে অবিরাম বর্ষণের ফলে নিম্নাঞ্চলের ২২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে এবং ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। পাইকগাছার ১৩টি গ্রামের কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। স্থানীয় লোকজন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড মিলে চার দিন ধরে চেষ্টা করেও ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধ মেরামত করতে পারেনি।
বাগেরহাট শহরের বেশির ভাগ এলাকা শনিবার রাতের ভারী বর্ষণের ফলে তলিয়ে গেছে। রামপাল, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা এবং কচুয়ার নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, তবে হাওড়া নদীর কয়েকটি বাঁধসহ সড়ক ধসে পড়েছে। আখাউড়া স্থলবন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম এখনও বন্ধ রয়েছে। কসবায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও বায়েক ইউনিয়নের অন্তত ১৫টি গ্রাম এখনও পানিবন্দি। রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাতেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। রাঙামাটিতে নৌ পুলিশ দুর্গত মানুষের মধ্যে খাদ্য সহায়তা বিতরণ করেছে।
সরকার সর্বশক্তি দিয়ে বন্যা মোকাবিলা করতে চায়
সরকার সর্বশক্তি দিয়ে বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চায় বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ। নোয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজ আশ্রয়ণ কেন্দ্র পরিদর্শন এবং ত্রাণ বিতরণের সময় তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের ইচ্ছার কোনো ঘাটতি নেই। প্রত্যেক জেলায় তরুণরা একত্রিত হয়ে বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। সমালোচনা না করে তাদের পাশে দাঁড়ান, যেন আমরা সর্বশক্তি দিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারি।