ইকতেদার আহমেদ: যে কোনো দেশের বিচারব্যবস্থার দক্ষতা, সততা, একাগ্রতা ও সামর্থ্য বলে দেয় সে দেশটি কতটুকু উন্নত ও সভ্য। একজন ব্যক্তিবিচারকের মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, ন্যায়পরায়ণতা, মননশীলতা প্রভৃতি সামগ্রিকভাবে বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে একজন ব্যক্তিবিচারকের অবিচারসুলভ কার্যকলাপ সমগ্র বিচারব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। আমাদের উচ্চ আদালতে বর্তমানে এমন বিচারপতি বা বিচারক খুঁজে পাওয়া বিরল যিনি মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার মাপকাঠিতে একজন আদর্শবান হিসেবে অন্য সবার জন্য অনুস্মরণীয়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিচার বিভাগ অন্যতম। পৃথিবীর যে কোনো সভ্য দেশে শাসন বা নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানবোধের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে থাকে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগ বিচার বিভাগবিষয়ক। এ ভাগটিতে তিনটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রথম পরিচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্ট বিষয়ে, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে অধস্তন আদালত বিষয়ে এবং তৃতীয় পরিচ্ছেদে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম পরিচ্ছেদের অনুচ্ছেদ ৯৪ থেকে ১১৩-এ ২১টি অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টবিষয়ক, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ১১৪ থেকে ১১৬ক এ চারটি অনুচ্ছেদ অধস্তন আদালতবিষয়ক এবং তৃতীয় পরিচ্ছেদের ১১৭ অনুচ্ছেদটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালবিষয়ক।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগ দুটি ভাগে বিভক্ত। যথা উচ্চ আদালত ও অধস্তন আদালত। উচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এ আদালতে দুটি বিভাগ রয়েছে। যথা আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট বিভাগ। প্রধান বিচারপতিসহ কতজন বিচারক সমন্বয়ে আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট বিভাগ গঠিত হবে, এ ব্যাপারে সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে কোনো কিছু বলা না থাকলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় প্রশাসনিক আদেশবলে একদা আপিল বিভাগে বিচারকের সংখ্যা ১১-তে উন্নীত করে দুটি বেঞ্চ গঠন করেছিল।
উচ্চ আদালতের বিচারকরা সাংবিধানিক পদধারী অপরদিকে অধস্তন আদালতের বিচারকরা একই সঙ্গে সংবিধানে বর্ণিত বিচার বিভাগীয় পদে দায়িত্ব পালনরত এবং সরকারি কর্মচারী। উচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ সাধারণত সংবিধান এবং সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী এতদুদ্দেশ্যে প্রণীত আইনের অধীন হওয়ার কথা থাকলেও একদা অধ্যাদেশ আকারে একটি আইন প্রণীত হলেও পরবর্তী সময়ে অধ্যাদেশটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত না হওয়ায় এটি কার্যকারিতা হারায়।
প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারকদের বিচারকার্য পরিচালনা বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪ দফা (৩)-এ সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে, প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগে নিযুক্ত বিচারকগণ কেবল উক্ত বিভাগে এবং অন্যান্য বিচারক কেবল হাই কোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করবেন। এ অনুচ্ছেদটির বর্ণনা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে ধারণা পাওয়া যায় বিচারকার্য পরিচালনার নিমিত্ত প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বা হাই কোর্ট বিভাগের বিচারকদের স্ব-স্ব বিভাগে আসন গ্রহণপূর্বক বিচারকার্য পরিচালনা ব্যতীত অপর কোনো ধরনের কার্য পরিচালনা সাংবিধানিকভাবে বারিত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এ ট্রাইব্যুনালের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের ক্ষেত্রে যে যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে তা হলো, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে কর্মরত অথবা বিচারক ছিলেন অথবা বিচারক হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান অথবা মেম্বার হবেন। এ বিধানটি সংবিধানে বিবৃত প্রধান বিচারপতি ও হাই কোর্ট বিভাগে কর্মরত বিচারকদের বিচারকার্য পরিচালনা বিষয়ে আসন গ্রহণবিষয়ক বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের কোনো পদে সুপ্রিম কোর্টের কর্মরত বিচারকের নিয়োগ সংবিধান কোনোভাবেই অনুমোদন করে না।
সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে চার ধরনের বিচারক রয়েছেন। যথা প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারক, হাই কোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারক এবং হাই কোর্ট বিভাগের অস্থায়ী বিচারক। প্রধান বিচারপতি ও অপরাপর বিচারকের নিয়োগ বিষয়ে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারকগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।
আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে, তা হলো তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, আইনজীবীর ক্ষেত্রে তার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে অন্যূন ১০ বছরকাল কার্য সম্পাদনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় পদে অন্যূন ১০ বছর অধিষ্ঠিত থাকতে হবে এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা থাকতে হবে।
উপরিউক্ত যোগ্যতাসমূহ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় দুই শ্রেণির ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য যোগ্য করায় যে কোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে অনুপাত হবে সমানুপাতিক। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ২০০১ খ্রিস্টাব্দ-পরবর্তী প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনজীবী ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুপাত ছিল কোনো সময় ৭০ : ৩০ আবার কখনো ৮০ : ২০। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যখন অংশের বিভাজন না দেখিয়ে দুই ভাইয়ের নামে এক বিঘা ভূমি ক্রয় করা হয় তখন এ বিষয়ে কারও মধ্যে কোনো ধরনের দ্বিমত থাকে না যে জমির মালিকানায় দুই ভাইয়ের অংশ সমানুপাতিক। দীর্ঘদিন যাবৎ বৈষম্যমূলকভাবে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানের চেতনার উপেক্ষা ও অবজ্ঞায় আইনজীবীদের অনুকূলে এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রতিকূলে নিয়োগকার্য যে সমাধা করা হয়ে চলছে এর আইনানুগ ও ন্যায়সংগত সমাধান অত্যাবশ্যক।
অধিকন্তু বিগত দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে অধস্তন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে এবং এমনো দেখা গেছে, জ্যেষ্ঠ ৫৩ জন আবার জ্যেষ্ঠ ২০৫ জনকে অতিক্রান্ত করে যথাক্রমে ৫৪নং ও ২০৬নং ক্রমিকের কর্মকর্তাকে উচ্চ আদালতে বিচারক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উপরিউক্ত দুটিসহ এ ধরনের প্রতিটি জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নিয়োগবিষয়ক যে সারসংক্ষেপ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরিত হয়েছিল তাতে অবশ্যই ব্যাখ্যাসহকারে যুক্তি উপস্থাপন অত্যাবশ্যক ছিল যে অতিক্রান্ত প্রতিটি কর্মকর্তার তুলনায় মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার বিচারে ৫৪নং ও ২০৬নং ক্রমিকের কর্মকর্তাদ্বয়সহ অপরাপর কনিষ্ঠ যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা উৎকৃষ্ট গুণাবলির অধিকারী। আর এ ধরনের ব্যাখ্যা না থেকে থাকলে যেসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ণকরে তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে এর প্রতিবিধান জরুরি। এ অন্যায়ের সঙ্গে সরাসরি যারা সম্পৃক্ত তারা হলেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী। যথাযথ কারণ ব্যতিরেকে একজন বিচারককে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে অন্যায়ের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদের জীবনের সব পুণ্য যে এ একটি অন্যায়ে বিলীন, এ সত্যটি বোঝার বোধশক্তি কী তাদের আছে!
যথাযথ ও যুক্তিসংগত কারণ ব্যতিরেকে একজন বিচারকের জ্যেষ্ঠতা ক্ষুণ্ণকরে তাকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন যাবৎ অধস্তন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে যে বিপুলসংখ্যক বিচারককে হতাশায় নিমজ্জিত করে অবমাননাকর অসহনীয় পরিবেশে চাকরিতে রেখে অধস্তন বিচার বিভাগের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করা হয়েছে তা কখনো একটি দেশের বিচার বিভাগের মৌল কাঠামোর ভিতকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে সহায়ক নয়।
অতীতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের জ্যেষ্ঠতার ক্রম রক্ষা করে ঢাকার জেলা জজ পদসহ আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব থেকে সচিব অবধি পদসমূহে, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার যা বর্তমানে রেজিস্ট্রার জেনারেল, আইজিআর এবং পুরাতন জেলাসমূহের জেলা জজ পদে পদায়ন করা হতো। বিগত দুই যুগেরও অধিক সময় জ্যেষ্ঠতার মান রক্ষা করে পদায়নকার্য সমাধা না হওয়ায় জনবিপ্লব অব্যবহিত পূর্বের সরকারের সময়কালে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব পদায়নে সংশ্লিষ্ট বিচারকের রাজনৈতিক মতাদর্শ মুখ্য বিবেচিত হয়েছে।
বিচার বিভাগের নিম্নতম পদ সহকারী জজ। সহকারী জজগণ অতীতে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। বর্তমানে সহকারী জজগণ বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে আসছেন। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নামে স্বতন্ত্র অস্তিত্ববিশিষ্ট কোনো পদ নেই। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের মূল পদ সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ বা যুগ্ম জেলা জজ বা অতিরিক্ত জেলা জজ। সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য একজন প্রার্থীর ন্যূনতম যে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন তা হলো, মাধ্যমিক থেকে আইন বিষয়ে ¯œাতক অথবা ¯œাতক সম্মান অথবা এলএলএম পর্যন্ত সব পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা বিষয়ে অদ্যাবধি আইন প্রণীত না হলেও বিচার বিভাগের নিম্নতম পদের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত থাকায় এর নিচের শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির উচ্চ আদালতে বিচারক পদে নিয়োগ লাভের সুযোগ নেই। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক এ নিয়োগকার্যটি সমাধা হয় বিধায় নিয়োগবিষয়ক সারসংক্ষেপ প্রেরণকালে শিক্ষাগত যোগ্যতা যে সহকারী জজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নিচের নয় এতদসংক্রান্ত প্রত্যয়ন জরুরি। কিন্তু বিগত দুই যুগেরও অধিক সময় এসব নিয়োগ প্রদানে রাজনৈতিক বিবেচনা মুখ্য হওয়ায় শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টির ওপর কোনোরূপ গুরুত্বারোপ করা হয়নি। অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিচার বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে পরিপক্বতা অর্জন করে ধীরে ধীরে পদোন্নতি লাভ করে অধস্তন বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদ জেলা জজ পদে আসীন হন। তাই বিচার বিভাগের জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের চেতনার আলোকে যৌক্তিক হারে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হলে উচ্চ আদালতে অধিক হারে নিরপেক্ষ, সৎ ও দক্ষ বিচারকের সমাগম ঘটবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক