সমতট ডেক্স: “নতুন বছরের প্রথম দিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে সব পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার এনসিটিবির পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। আর মাত্র একদিন বাকি থাকলেও এ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ বইও ছাপা হয়নি। ফলে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণ নিয়ে চরম হযবরল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় বছরের শুরুতে সব বই হাতে পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। চার শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একটি বইও হাতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এ জন্য সময় স্বল্পতা এবং মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১ জানুয়ারি সব শ্রেণির বইগুলো পিডিএফ আকারে অনলাইনে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ। এদিকে পাঠ্যবই ছাপা শেষ না হওয়ায় ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক প্রাপ্তি এবং শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করা নিয়ে উৎকণ্ঠায় শিক্ষার্থী শিক্ষক-অভিভাবকরা।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান বলেছেন, ‘২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬ কোটি বই ছাপা ও বাঁধাই শেষ হয়েছে। দুদিনে আরও এক থেকে দেড় কোটি বই ছাপা হবে। ১ জানুয়ারি সব শ্রেণির দু-তিনটি করে বই দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা।’
এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ আরও বলছেন, মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে জড়িত কিছু অসাধু ব্যক্তির অসহযোগিতা ও ষড়যন্ত্রের কারণে সব পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। অতীতের মতো তারা সবাইকে জিম্মি করে যথেচ্ছভাবে নিম্নমানের বই সরবরাহের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তারা নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিগত ১৫ বছরের মতো এবারও মুদ্রণশিল্পের অসাধু ব্যক্তিরা টাকার বিনিময়ে কিনতে চেয়েছিল এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের, কিন্তু তা সম্ভব না হওয়ায় বিভিন্নভাবে সরকারের মহৎ উদ্যোগকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, সরকারি পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের বিষয়ে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কেননা, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাপাখানার মালিক ও মুদ্রণশিল্প সমিতির নেতাদের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা আমাদের আশ্বস্ত করে আসছিল প্রায় সব বই যথাসময়ে সরবরাহের। কিন্তু হঠাৎ তাদের কথাবার্তা ও আচরণ রহস্যজনক মনে হয়েছে। এমনকি তাদের অনুরোধ করেও প্রায় ২০০ লটে চুক্তিবদ্ধ করানো যায়নি, এটাও রহস্যজনক।
এনসিটিবি সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বছরের প্রথম দিন দেশের সব উপজেলায় চতুর্থ, পঞ্চম, অষ্টম ও নবম শ্রেণি বাদে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কমবেশি বই হাতে পাবে। তবে উল্লেখিত চতুর্থ শ্রেণির অধিকাংশ শিক্ষার্থী বছরের শুরুতে কোনো বই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এনসিটিবি সূত্র প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ৭০ লটের বই ছাপা শেষ। সেগুলো উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তবে পুনঃটেন্ডার হওয়ায় বাকি ২৭ লটের বই এখানো ছাপা শেষ হয়নি। এ তিন শ্রেণির বই ছাপা শেষ করে পৌঁছে দিতে জানুয়ারি মাসের পুরোটা সময় লেগে যেতে পারে। প্রাথমিকের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপার কাজ এখনো শুরু হয়নি। সেক্ষেত্রে এ দুটি শ্রেণির বই হাতে পেতে শিক্ষার্থীদের জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। সব বই পৌঁছাতে এনসিটিবির পুরো জানুয়ারি লেগে যেতে পারে।
আর মাধ্যমিকে ষষ্ঠ-দশম শ্রেণির দেড় কোটির কিছু বেশি বই ছাপা হয়েছে, যার মধ্যে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছাপানো হয়েছে প্রায় ১ কোটি বই। সাধারণ প্রেস মালিকদের ছাপাখানায়ও ষষ্ঠ-সপ্তমের কিছু বই ছাপার কাজ শেষ। সবমিলিয়ে ষষ্ঠ-সপ্তমের দুটি করে বই কিছু উপজেলার স্কুলে যেতে পারে। তা ছাড়া দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দু-তিনটি করে বই কিছু উপজেলার শিক্ষার্থীরা হাতে পেতে পারে।
তবে অষ্টম ও নবম শ্রেণির অধিকাংশ শিক্ষার্থী বছরের শুরুতে কোনো বই নাও পেতে পারে। বই হাতে পেতে তাদের পুরো জানুয়ারি অপেক্ষা করতে হতে পারে। অষ্টম-নবমের শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছে দিতে আরও দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগতে পারে এনসিটিবির।
সব শিক্ষার্থীর হাতে এবার বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দিতে না পেরে নতুন পরিকল্পনা করেছে এনসিটিবি। প্রাথমিকের তিনটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব বই পেলেও চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপানো শেষ হয়নি। মাধ্যমিকের কোনো শ্রেণির বই ছাপা সহসাই শেষ হচ্ছে না। পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে এমন নাজুক অবস্থার কারণ হিসেবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সময়ের স্বল্পতা এবং মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ষড়যন্ত্রকে দোষ দিচ্ছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা। তবে তাদের এমন কথায় ‘সন্তুষ্ট নন’ খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
শিক্ষক-অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা পাঠ্যবই নিয়ে এমন নাজুক অবস্থার জন্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তাদের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন। এনসিটিবিতে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরতদের ভাষ্য, বর্তমান চেয়ারম্যান, সদস্য থেকে শুরু করে সব দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাই ‘অনভিজ্ঞ’। হঠাৎ দায়িত্ব নিয়ে তারা এত বড় কাজ সামাল দিতে পারছেন না। প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেটকে সহজ-সরলভাবে বিশ্বাস করায় নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছেন তাদের।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সূত্র জানায়, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩। তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকের ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই।
আর মাধ্যমিক পর্যায়ের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। তা ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা ছাপা হবে।
ছাপাখানার মালিক, মুদ্রণশিল্প সমিতি ও এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২৯ ডিসেম্বর বিকাল পর্যন্ত প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ষষ্ঠ, সপ্তম ও দশম শ্রেণির সবমিলিয়ে ৬ কোটির মতো বই ছাপা হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও ১ কোটির মতো বই ছাপা হতে পারে। সেক্ষেত্রে ৭ কোটি বই বছরের প্রথম দিনে পৌঁছানো সম্ভব হবে।