চলমান তাপদাহে গলে যাচ্ছে সড়ক ও মহাসড়কের বিটুমিন (পিচ)। ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলোতে প্রায়ই তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের ভাষ্য, তাপে পিচ গলে সড়ক নষ্ট হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিটুমিনের মান এবং সড়ক নির্মাণের দক্ষতায় রয়েছে প্রশ্ন। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে সড়ক-মহাসড়ক।
সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সড়কে ৬০-৭০ গ্রেডের পিচ ব্যবহার করা হয়। এর গলনাঙ্ক ৪৮ থেকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ, ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এই মানের পিচ গলে যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) উৎপাদিত পিচের গলনাঙ্ক ৫২ থেকে ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পলিমার মডিফায়েড বিটুমিনের (পিএমবি) গলনাঙ্ক ৭০ ডিগ্রির বেশি। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এবং এলেঙ্গা-রংপুর মহাসড়কে পিএমবি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব সড়কে পিচ গলছে না।
সওজের একাধিক প্রকৌশলী সমকালকে জানিয়েছেন, তিন কারণে পিচ গলছে। প্রথম কারণ, বাতাসের আর্দ্রতা কম। তাই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি হলেও পিচের উপরিভাগে বাতাসের তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রির বেশি হয়ে যায়। দ্বিতীয় কারণ, পিচ কালো রঙের হওয়ায় সূর্যের তাপ শোষণ করে আরও উত্তপ্ত হয়। তৃতীয় কারণ, গাড়ির চাকার ঘর্ষণে উৎপন্ন তাপে সড়কের তাপ ৫০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে বিটুমিন গলছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদীউজ্জামান সমকালকে বলেছেন, একসময় ৩০-৩২ ডিগ্রি তাপমাত্রা সহনীয় ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হতো। সড়কের স্থায়িত্ব বাড়াতে বেশি দামের ৬০-৭০ গ্রেডের পিচ ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু আসলেই তা ৬০-৭০ গ্রেডের কিনা, নাকি ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে নিম্নমানের পিচ ব্যবহার করা হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিটুমিন ব্যবহারের আগে সঠিক তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য শ্রমিক এবং প্রকৌশলীর দক্ষতা প্রয়োজন। বিটুমিন ঢালাইয়ের পর কিউরিংয়ের জন্য সময় দিতে হয়। নিয়ম মেনে তা না চললে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিনও টিকবে না। পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন আমদানি করতে হয়, দামও বেশি। পিএমবি ভালো, কিন্তু নিয়ম মেনে কাজ না করলে তাও টিকবে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েকটি অংশে ব্যবহার করা হয়েছিল, টেকেনি।
সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান সমকালকে বলেন, মান যাচাই করে বিটুমিন ব্যবহার করা হয়। সড়ক নির্মাণের পর আবার পরীক্ষা হয়। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের সুযোগ নেই। আর গরমে পিচ গলে যাওয়া নতুন কিছু নয়।
পিচ গলে যাওয়ায় কী কী সমস্যা হতে পারে– প্রশ্নে হাদীউজামান বলেছেন, এতে সড়কে ফ্রিকশন থাকছে না। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পিচ গলে হাজার কোটি টাকায় নির্মাণ করা সড়কের স্থায়িত্ব শেষ হতে পারে।
শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, তীব্র গরমে শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের বালি বাড়ির মোড় থেকে নরসিংহপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে গলে যাচ্ছে বিটুমিন। বিটুমিন গলে যাওয়ায় সড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে ধীরগতিতে যানবাহন চালাচ্ছেন চালকরা। এ ছাড়া বিটুমিন গলে যাওয়ার ফলে সড়কের পাথর সরে গিয়ে সড়কটি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কের ভেদরগঞ্জ উপজেলার বালি বাড়ির মোড় থেকে নরসিংহপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থান ভেজা। ১৭ কিলোমিটারের এই সড়কটির প্রায় ১৫টি স্থানে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে বিটুমিন গলে সড়কটি ভিজে গেছে। ভেজা অংশ দিয়ে গাড়ি চালাতে গেলে টায়ারের সঙ্গে বিটুমিন লেগে যাচ্ছে। ভেজা স্থান দিয়ে ট্রাকসহ যানবাহন ধীরগতিতে চলাচল করছে। আমান আহমেদ নামে একজন মাইক্রোবাসচালাক বলেন, একটু অসাবধানতার কারণে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
শরীয়তপুরের সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল হোসেন বলেন, সড়কের বিটুমিন গলে যায়নি। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ব্যবহৃত বিটুমিনের ব্লিডিং (ফুলে যাওয়া) হয়। তাপপ্রবাহ কমে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে নতুন করে বিটুমিনের লেয়ার দিয়ে দেওয়া হবে।
কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, কালিয়াকৈর-ফুলবাড়িয়া আঞ্চলিক সড়কের কাজ সম্পন্ন হয় চার বছর আগে। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক সংস্কারে গত বছর দরপত্র আহ্বান করে সওজ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রিলাইয়াবুল বিল্ডার্স লিমিটেড সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশে ডিবিএসটি (স্টান্ড ফর ডাবল বিটুমিনস সারফেস ট্রিটমেন্ট) কাজ হয় ফেব্রুয়ারিতে। সরেজমিন দেখা গেছে, সড়কের কাঞ্চনপুর, মেদিয়া শোলাই, মেদি বাজার, পাইকপাড়া, কতুবদিয়াসহ কমপক্ষে ১০ পয়েন্টে বিটুমিন গলে যাচ্ছে। দুর্ঘটনা এড়াতে এর ওপর বালু দিচ্ছেন সওজের কর্মীরা।
মেসার্স রিলাইয়াবুল বিল্ডার্স লিমিটেডের সহকারী প্রকৌশলী শাহীন আলম বলেন, নিম্নমানের কাজ নয়, গরমে বিটুমিন গলেছে।
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তাপপ্রবাহে চুয়াডাঙ্গা-কালীগঞ্জ এবং চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কের কয়েকটি স্থানে পিচ গলে গাড়ির চাকা বা পথচারীর জুতার সঙ্গে পিচ উঠে আসছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের কাজে এ অবস্থা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা হাটকালুগঞ্জের বাসিন্দা মো. শাহিন বলেন, রাস্তা ঠিকভাবে নির্মাণ হয়নি। তাই পিচ গলে গর্ত হয়ে যাচ্ছে। সড়ক উঁচু-নিচু হয়ে যাচ্ছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জহিরুল লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী জহিরুল ইসলাম বলেন, সড়কগুলো চার বছরের বেশি সময় আগে নির্মাণ করা। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার হয়নি। তাপে গলছে বিটুমিন।
সওজের চুয়াডাঙ্গার নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা বলেন, সড়কের কোনো কোনো বিটুমিনের পরিমাণ বাড়তি থাকে। গরম বেশি পড়লে তা গলে যাবেই। নিম্নমানের পিচ দিলে সড়ক এতদিন টিকত না।
যশোর অফিস ও নড়াইল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পিচ গলে কাদার মতো গলে গেছে পুনর্নির্মাণাধীন যশোর-নড়াইল মহাসড়কে। সরেজমিন দেখা গেছে, নীলগঞ্জ, হামিদপুর, দায়তলা, ফতেপুর, তারাগঞ্জ এবং নড়াইল সদরের মাদ্রাসা বাজার, সুলতান ব্রিজ, সীতারামপুরসহ বিভিন্ন স্থানে গরমে বিটুমিন গলছে। এতে ১০ কিলোমিটার এলাকার যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সওজ গলে যাওয়া পিচের ওপর বালু ও পাথরের কুচি দিলেও যানবাহনের চলাচলে স্থায়ী হচ্ছে না।
বাসচালক সোলায়মান হক জানান, এই সড়কে কখনও এ অবস্থা দেখেননি। বাস চালাতে ভয় লাগে।
সওজের যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া জানান, যেসব স্থানে বিটুমিনের পরিমাণ বেশি, গরমে তা গলে যাচ্ছে। এতে সড়কের কাজের মান নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কিন্তু আসলে নির্মাণত্রুটিতে এমন হয়নি।
উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বগুড়া-পাবনা মহাসড়কে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল, বোয়ালিয়া বাজার, শ্যামলীপাড়া বাসস্ট্যান্ড, শ্রীকোলা ও কাওয়াক মোড়ের পাশে রাস্তার পিচ গলে গেছে। কোথাও কোথাও মহাসড়কের কিছু অংশ চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি দেবে গেছে।
উল্লাপাড়া-রাজশাহী রুটের বাস রতন পরিবহনের সুপারভাইজার শহিদুল ইসলাম জানান, দেবে যাওয়া অংশে প্রতিদিন গতি কমিয়ে চলতে হচ্ছে।