সমতট ডেক্স: অধিকাংশ পাঠ্যবই ছাড়াই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে নতুন বছরে শিক্ষাবর্ষ শুরু করতে যাচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা। প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বছরের প্রথম দিনে অধিকাংশ পাঠ্যবই পেলেও অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দুই থেকে তিনটি করে বই পেতে পারে।
আবার কোনো কোনো শ্রেণির শিক্ষার্থীরা একটি বইও হাতে পাবে না। কবে নাগাদ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা সব পাঠ্যবই হাতে পাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি)।
মুদ্রণশিল্পের সঙ্গে জড়িত কিছু অসাধু ব্যক্তির ষড়যন্ত্রে এনসিটিবির পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করেছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা। মাঠ পর্যায়ে তথ্য নিয়েও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে ষড়যন্ত্রের তথ্য পাওয়া গেছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে যাতে এনসিটিবি বই তুলে না দিতে পারে সে লক্ষ্যে কলকাঠি নাড়তে শুরু থেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠে একটি চক্র। তারা অযথা সময়ক্ষেপণ করে লক্ষ্য হাসিল করতে চায়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও এনসিটিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা মিলেছে।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মুদ্রণশিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি এবং যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সরকারকে বিব্রত করতে প্রথম থেকেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এরই অংশ হিসেবে সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণের জন্য ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময় চেয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর চিঠি পাঠিয়েছিলেন মুদ্রণশিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর তড়িঘড়ি করে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ক্ষমা চান মাহফুজ।
সেই সঙ্গে বিষয়টি জানার পরও বাধা না দেওয়ায় ক্ষমা চেয়েছেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাউসার উজ্জামান রুবেল এবং সমিতির প্যাডে চিঠিটি যাওয়ায় নিজের দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন সমিতির সভাপতি রাব্বানী জাব্বারও। রাব্বানী সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের আপন ভাই।
ওই গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রটি আরও জানায়, শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর চিঠি পাঠানোর বিষয়টিও ছিল তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ। আর এর পরিকল্পনা হয়েছিল মালিবাগের সিআইডি অফিসে উল্টো দিকে স্কাই সিটি হোটেলের এক কক্ষে। যেখানে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি এবং যুবলীগ নেতা জহিরুল ইসলাম গোপন বৈঠক করে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। এতে বেশ কয়েকজন ছাপাখানার মালিক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
তবে জহিরুল ইসলাম এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ওই হোটেলটি বিএনপি নেতার, দীর্ঘদিন থেকে ওই হোটেলে যাওয়া হয় না আমার। আমার প্রতিষ্ঠান এবার কোনো কাজও পায়নি, ফলে গোপন বৈঠক কিংবা ষড়যন্ত্রের প্রশ্নই ওঠে না। বরং আমরা সরকারকে সহযোগিতা করে আসছি। তিনি বলেন, আমি ২০১২ সালে যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলাম এরপর থেকে আর কোনো পদে নেই।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, সরকারি পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ মহলের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে আমাদের কাছেও খবর এসেছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় এ মুহূর্তে আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। ষড়যন্ত্র যে হয়েছে এর কিছু তথ্য-উপাত্তও আমাদের কাছে আছে। কেননা, ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাপাখানার মালিক ও মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতাদের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা আমাদের আশ্বস্ত করে আসছিল চুক্তি অনুযায়ী প্রায় সব বই যথাসময়ে সরবরাহের।
কিন্তু হঠাৎ তাদের কথাবার্তা ও আচরণ রহস্যজনক মনে হয়েছে। এমনকি তাদের অনুরোধ করেও প্রায় ২০০ লটে চুক্তিবদ্ধ করানো যায়নি, এটাও রহস্যজনক। তারা যে কাগজ, আর্টপেপার ও অর্থসংকটের কথা বলছেন তা সঠিক নয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও তারা নানা বাহানায় পাঠ্যপুস্তক নিয়ে টালবাহানা করছেন।
চেয়ারম্যান বলেন, চুক্তি অনুযায়ী যথাসময়ে পাঠ্যপুস্তক না পেলে তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক জরিমানার পাশাপাশি আইনগতভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা আশা করছি, তারা আমাদের সহযোগিতা করবেন।
এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩। তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকের ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। তা ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা ছাপা হচ্ছে।
এদিকে নতুন বছরের প্রথম দিনে সারা দেশে সব শিক্ষার্থী সব বই পাচ্ছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে অন্ততপক্ষে তিনটি করে নতুন বই (বাংলা, ইংরেজি ও গণিত) দিয়ে শিক্ষাবর্ষ শুরু করার যে পরিকল্পনা করছিল এনসিটিবি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বই ছাপা না হওয়ায় সেই পরিকল্পনাও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণে একটা লেজেগোবরে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এতে আজ বুধবার অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাঠ্যবই ছাড়াই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে নতুন বছরে শিক্ষাবর্ষ শুরু করতে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একেএম রিয়াজুল হাসান বলেন, মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত প্রায় ৯ কোটি বই ছাপা হওয়ার পর তা বিতরণের জন্য পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকের সাড়ে ৪ কোটি এবং মাধ্যমিকের ৪ কোটি ৪২ লাখ বই।
তিনি বলেছেন, বছরের প্রথম দিনেই সব শিক্ষার্থী অন্তত তিনটি করে বই পাবে। এর মধ্যে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের কিছু বইও পাবে। ৫ জানুয়ারির মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির সব বই পৌঁছে যাবে।
ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য তিনটি করে বই পাবে। এ ছাড়া বাকি বইগুলো ১০ জানুয়ারি এবং ২০ জানুয়ারির মধ্যে সব শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছোনো কথা থাকলেও তা নিয়েও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
নতুন পরিকল্পনা অনলাইন
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা ১০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বই না পেয়ে ক্লাস শুরু করা নিয়ে বিপাকে পড়তে পারে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। সেক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে বছরের প্রথম দিন সব শ্রেণির বইয়ের পিডিএফ কপি ওয়েবসাইটে আপলোড করবে এনসিটিবি। সেখান থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা বইয়ের পিডিএফ কপি ডাউনলোড করে নিতে পারবেন।
প্রয়োজনে কিছু অংশ প্রিন্ট করে পড়তে পারবে। অনলাইনে বইয়ের পিডিএফ কপি দেওয়া হলে শিক্ষার্থীদের সুবিধা হবে বলে জানান এনসিটিবি চেয়ারম্যান। তিনি জানান, ১ জানুয়ারি মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষা উপদেষ্টা অনলাইন ভার্সন বইয়ের উদ্বোধন করবেন।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের বিনামূল্যের মূল পাঠ্যবইগুলোর মধ্যে ৬৯১টি বই নতুন করে পরিমার্জন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪১টি বইয়ের পরিমার্জন সম্পন্ন করে পিডিএফ ভার্সনে রূপান্তর করা সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই এই পিডিএফ ফাইলগুলো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে।
অন্যদিকে, চলতি বছরের সব পাঠ্যবই আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিলেও মুদ্রণ সমিতি ও ছাপাখানার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে আগামী দুই মাসেও পুরো পাঠ্যবই শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।