ওবায়দুল্লাহ রনি : খেলাপি ঠেকাতে গত পাঁচ বছরে আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনঃতপশিল করেছে ব্যাংকগুলো। সবচেয়ে বেশি ৯১ হাজার ২২১ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতপশিল করা হয়েছে নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালে। এর পরও ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ না কমে উল্টো বেড়েছে। আগের সব রেকর্ড ভেঙে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় যা ৬৬ হাজার কোটি টাকা বেশি।
বিগত সরকারের সময়ে বিভিন্ন কৌশলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে কখনও বিশেষ ব্যবস্থায় ১২ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতপশিল,
কখনও পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব ছাপিয়ে করোনার পর ২০২০ সালে এক টাকা না দিলেও খেলাপি করা হয়নি। ২০২১ সালে মাত্র ১৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৫০ শতাংশ কিস্তি দিলেই নিয়মিত রাখা হয়েছে। আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে যোগদানের এক সপ্তাহের মাথায় ২০২২ সালের ১৮ জুলাই ব্যাপক শিথিল করে ঋণ পুনঃতপশিলের একটি নীতিমালা করা হয়। ওই নীতিমালার পর আগের সব রেকর্ড ভেঙে গত দুই বছরে পুনঃতপশিল করা হয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পুনঃতপশিল হওয়া ঋণের মধ্যে ৮১ দশমিক ৩০ শতাংশ ছিল নিয়মিত ঋণ। বাকি ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল খেলাপি। ২০২২ সালে পুনঃতপশিল হয় ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে হয়েছিল ২৬ হাজার ৮১০ কোটি টাকা এবং ২০২০ সালে ১৯ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। ওই তিন বছর পুনঃতপশিল হওয়া ঋণের ৮০ দশমিক ৪০ থেকে ৮০ দশমিক ৮০ শতাংশ ছিল নিয়মিত ঋণ। আর ২০১৯ সালে ৭৮ দশমিক ১০ শতাংশ ছিল নিয়মিত। বাকি ২১ দশমিক ৯০ শতাংশ ছিল খেলাপি। ওই বছর মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ১২ বছরের জন্য পুনঃতপশিলের সুযোগ দেওয়া হয়। নিয়মিত ঋণ পুনঃতপশিলের মানে পরিশোধের শর্ত আরও সহজ করা। এ ক্ষেত্রে সাধারণত সুদের হার কমানো হয় এবং পরিশোধের সময় বাড়ানো হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা সমকালকে বলেন, ঋণ পুনঃতপশিলের নীতিমালা সহজ করে ২০২২ সালে পুরো প্রক্রিয়া ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এর পর থেকে পুনঃতপশিলের জন্য আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসতে হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো এ সুযোগের অপব্যবহার হয়েছে। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে ইচ্ছামতো নিজেরাই পুনঃতপশিল করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা না থাকায় গুণগত মান যাচাই না করেই ঋণ নিয়মিত করেছে। যে কারণে একই ঋণ আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। যে কারণে খেলাপি ঋণ আদতে না কমে আগের চেয়ে বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ঋণ পুনঃতপশিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য আসার সংস্কৃতি ভালো ছিল না। তবে যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তা এ খাতের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। আগে যেখানে একটি ঋণ পুনঃতপশিলে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। আর তিন দফায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্য পুনঃতপশিল করা যেত। এর বাইরে সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসতে হতো। তবে নতুন নীতিমালায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ চার দফায় ২৯ বছরের জন্য পুনঃতপশিলের সুযোগ দেওয়া হয়। আর ডাউনপেমেন্ট ধরা হয় মোট বকেয়ার আড়াই শতাংশ। ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার কম হলে বকেয়ার ৪ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হয়। এ সুবিধার পর থেকে ব্যাংকগুলো যথেচ্ছভাবে ঋণ পুনঃতপশিল করছে।
বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ আদায় বিভাগের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বারবার বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় অনেকেই আর কোনো কিস্তিই দিচ্ছে না। নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড নিয়ে ঋণ পুনঃতপশিল করছে। তাদের কৌশল হলো– কিস্তি না দিয়ে পরের বছর আবার এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডের জন্য আসবে। তিনি মনে করেন, ঋণ পুনঃতপশিলে ডাউনপেমেন্টর হার এত কমানো ঠিক হয়নি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। তিন মাস আগে গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের ঋণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা ছিল মোট ঋণের ৯ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে খেলাপি বাড়ে ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি এবং পরের তিন মাসে বাড়ে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য বিভিন্ন শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে। সংস্থাটি ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর শর্ত দিয়েছে। তবে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর জন্য আগের মতো নীতিসহায়তা দেওয়া যাবে না। বরং ২০১৯ সাল থেকে মেয়াদি ঋণ এক বছর কোনো কিস্তি না দিলেও তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে না করার বিধান তুলে দিতে হচ্ছে।