মোরশেদুল জাহের: বাংলাদেশে সাংবাদিকদের দায়িত্ব পালন বরাবরই অনিরাপদ। তারা দুই পক্ষেরই হামলার শিকার হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাংবাদিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হবে। এ জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন তারা।
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি বরাবরই আলোচনায় থাকলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি কখনো। কোনো ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায়নি সরকার কিংবা কর্তৃপক্ষের তরফে। বরং দিনে দিনে সাংবাদিক হত্যা, নিগ্রহ, হয়রানি বেড়েছে নানা মহল থেকে। এমনকি এসব ঘটনার বিচার যেমন হয়নি, তেমনি তদন্তের নামে বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে মামলা।
ঢাকায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার (২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি) এক যুগে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার তারিখ পিছিয়েছে শতাধিকবার। ১৬ বছর পর খুলনার হুমায়ুন কবির বালু হত্যা (২০০৪ সালের ২৭ জুন) মামলার বিচারিক আদালতে রায় হলেও ঝুলে আছে উচ্চ আদালতে। আর ২৪ বছরেও আসামিদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি যশোরের শামসুর রহমান মানিক হত্যা মামলাতেও (২০০০ সালের ১৬ জুলাই)।
সাংবাদিকের নিরাপত্তা নেই কোথাও। ঘরে নেই, অফিসে নেই, পথে নেই, মাঠে নেই। দীর্ঘদিন ধরে চোখের সামনে উদাহরণ হয়ে ছিল সাগর-রুনি, শামসুর রহমান মানিক ও হুমায়ুন কবির বালু হত্যা। তারা অনেকটা গুপ্তহত্যার শিকার হন সন্ত্রাসীদের হাতে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো দায়িত্ব পালনকালে প্রকাশ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার মতো ঘটনা। গত ১৮ জুলাই ছাত্র আন্দোলনরে সংবাদ সংগ্রহের সময় যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কাজলা এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকা টাইমসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাসান মেহেদী।
সাংবাদিকরা বলছেন, আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে এভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। দায়িত্ব পালনকালে নিহত হাসান মেহেদী দেশে প্রথম শহীদ সাংবাদিক। এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা জার্নালের প্রধান সম্পাদক যেমন বলেন, ‘হাসান মেহেদীর মৃত্যু একটা সাহসিক মৃত্যু। সম্মুখ সমরে দায়িত্বপালন করতে গিয়ে এভাবে পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা আর আছে কি না জানা নেই।’
এরপর ওই আন্দোলনে ১৮ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত আরও চারজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তাদের কেউ গুলিতে, কেউ কোনো পক্ষের মারধরের শিকার হয়ে মারা গেছেন। বিভিন্ন পত্রিকার খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ওই আন্দোলনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গুলি ও মারপিটে আহত হয়েছেন আড়াই শর বেশি সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী। এর মধ্যে গুরুতর আহত অন্তত ৭০ জন। ছররা গুলিতে আহত হন অন্তত ৪০ জন সাংবাদিক।
অর্থাৎ সাংবাদিকের নিরাপত্তা নেই কোনো পক্ষের কাছেই। বিক্ষোভকারী-আন্দোলনকারী কিংবা পুলিশ উভয়েই তাদের প্রয়োজন ও স্বার্থচিন্তায় শত্রু কিংবা মিত্র গণ্য করে সাংবাদিককে।
ঢাকা জার্নালের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা এক প্রতিক্রিয়ায় ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দুই পক্ষ থেকেই আক্রমণের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। ভাঙচুর করা হচ্ছে তাদের গাড়ি, ক্যামেরা, মোবাইল ফোন; শিকার হচ্ছেন গুলি-মারপিটের। এমনকি একজন নারী সাংবাদিককে যৌন হয়রানির শিকার হতে দেখেছি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জে নিহত হন সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক। ওই দিন অসহযোগ কর্মসূচি চলার সময় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ২৩ জন সাংবাদিক আহত হন।
এর আগে ১৯ জুলাই রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে আন্দোলনের ছবি তোলার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক তৌহিদ জামান প্রিয়।
একই দিনে সিলেটে দায়িত্ব পালনের সময় গুলিবিদ্ধ হন নয়া দিগন্ত পত্রিকার সাংবাদিক এ টি এম তুরাব। পরদিন হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।
ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসান যেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, সেই ১৮ জুলাই সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন দৈনিক ভোরের আওয়াজ পত্রিকার গাজীপুরের গাছা থানা প্রতিনিধি মো. শাকিল হোসেন।
আহত সাংবাদিকেদর মধ্যে পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল— সব মাধ্যমের সাংবাদিক রয়েছেন। পত্রিকার মধ্যে আমাদের সময়ের ৯ জন, কালের কণ্ঠের ছয়জন, সময়ের আলোর ছয়জন সংবাদকর্মী রয়েছেন। অন্য প্রায় সব পত্রিকার একাধিক সাংবাদিক গুলিবিদ্ধসহ নানাভাবে আহত হন ছাত্র আন্দোলনে দায়িত্বপালন করার সময়।
অনলাইন মিডিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহত হন বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক— পাঁচজন। বাংলা নিউজ২৪ ডটকমের তিনজন এবং আরও বেশ কিছু নিউজ পোর্টালের অনেক সাংবাদিক আহত হন গুলি ও মারপিটের শিকার হয়ে।
সবচেয়ে বেশি হামলার শিকার হয়েছেন টিভি সাংবাদিকরা। নিউজ২৪ টেলিভিশনের ১২ জন সাংবাদিক আহত হন। তাদের মধ্যে ছয়জন ছররা গুলিবিদ্ধ। ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ১০ জন, এনটিভির অন্তত ৮ জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী আহত হন। ৭১ টিভির ছয়জন গুলিবিদ্ধসহ ৭ জন আহত হন। এছাড়া প্রায় সব টিভির সাংবাদিক রয়েছেন আহতের তালিকায়। এমনকি জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেসহ বিদেশি সংবাদমাধ্যমে কর্মরত তিনজন বাংলাদেশ প্রতিনিধি আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজন গুলিবিদ্ধ।
আন্দোলনকারী কিংবা পুলিশের মতো মুখোমুখি সংঘর্ষের কোনো পক্ষ না হয়েও সাংবাদিকরা হামলার শিকার হন প্রতিনিয়ত। সাংবাদিকের নিরাপত্তা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘ঘটনাস্থলে যখন একজন সাংবাদিকের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, তখন শঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। এটা চলতে দেওয়া যায় না।’
আসকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমরা সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। এখন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হোক, সুরক্ষা ব্যবস্থার মাধমে হোক সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সমাজ টিকতে পারে না, দেশ ভালো অবস্থায় আছে এটা বলার সুযোগ নেই।’
সরকারের পাশাপাশি মিডিয়া কর্তৃপক্ষেরও সাংবাদিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন ঢাকা জার্নালের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। বলেন, ‘হাসান মেহেদি প্রাণ দিয়ে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রেখে গেছেন। আশা করব অন্য সাংবাদিকরা এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করবেন।’ সাংবাদিকরা কেন টার্গেট হন, এটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ সাংবাদিকদের জন্য নিরাপদ নয়। স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য যে নিরাপদ পরিবেশ দরকার, সেটি বাংলাদেশ দিতে পারছে না। এমনটাই মনে করেন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডা. আবদুন নূর তুষার।
হাসান মেহেদী হত্যার উদাহরণ দিয়ে আবদুন নূর তুষার বলেন, ‘মেহেদী নিহত হয়েছেন যেখানে, সেখানে পুলিশের পাহারা ছিল। সে মোটামুটি একটা নিরাপদ স্থানে দায়িত্ব পালন করছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। মানুষের জানমালের পাশাপাশি সাংবাদিকের নিরাপত্তা দেওয়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। সেটা নিশ্চিত করেই তাদের অ্যাকশনে যাওয়া উচিত।’
দায়িত্ব পালনকালে একজন সাংবাদিকের মৃত্যু দেশের বাকস্বাধীনতা, মানুষের জানমালের নিরাপত্তাসহ বহু সূচককেই নির্দেশ করে বলে মন্তব্য করেন নূর।
কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিকের নিরাপত্তা বরাবরই অবহেলিত হচ্ছে। সেটা যেমন সরকারের নানা আইন প্রণয়নে, তেমনি পেশাগত নানা অঙ্গনে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘সাংবাদিকের নিরাপত্তা নিয়ে সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা সম্মানের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। সংবাদ প্রকাশ কিংবা সংবাদ সংগ্রহকালে সাংবাদিকরা বিভিন্ন মহলের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, হত্যা-গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন।
নূর খান বলেন, ‘দেশে নানা ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু সরকার যখন কোনো বিষয়ে বিক্ষুব্ধ জনগণকে নিবৃত্ত করতে চায়, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে আচরণ করে তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ হলো দায়িত্বপালনরত সাংবাদিকের ওপর হামলা।’
এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন বলে মনে করেন এই মানবাধিকার কর্মী। তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ যখন কোনো অপারেশনে যাবে, তখন সাংবাদিকদের সঙ্গে আচরণ ও তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে ব্রিফ করা দরকার।’
নূর খান আরও বলেন, ‘সাংবাদিকের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হবে। সেটি যেমন ঘটনাস্থলে তাদের নিরাপত্তা দিয়ে, তেমনি হামলার শিকার সাংবাদিক ও তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে।’