সমতট ডেক্স : দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং বিএনপির সম্পর্কে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। ছাত্ররা যখন নিজের দাবি নিয়ে সোচ্চার, বিএনপি তখন তাদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে গভীর সন্দেহ এবং মতপার্থক্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষ করে— রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন, নির্বাচন ইস্যু এবং ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলছে, যেখানে ছাত্ররা সরকারের সংস্কার দাবির পাশে এবং বিএনপি তার নিজস্ব রাজনৈতিক পন্থায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই দ্বন্দ্ব শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে নয়, ছাত্র আন্দোলনের প্রতি বিএনপির আস্থার সংকটও তীব্র হয়ে উঠেছে, যা দেশের আসন্ন নির্বাচনী পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম তাদের বক্তব্যে যে তীব্র মতপার্থক্য প্রকাশ করেছেন, তা রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতা বাড়িয়েছে। মূলত, গেল বুধবার (২২ জানুয়ারি) যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম বিবিসিকে মির্জা আলমগীরের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। ওই সাক্ষাৎকারে দ্রুত নির্বাচন দাবির পাশাপাশি তিনি বলেন, ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করার পরও যদি সরকারে তাদের প্রতিনিধি থাকে, তাহলে সরকার নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। এভাবে তারা নির্বাচন করতে চাইলে রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না।
নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বিএনপি কেন মনে করে, সরকার কেবল একটি নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করছে, সেটি তার কাছে বোধগম্য নয়।
নির্বাচনের জন্য সরকার যতগুলো সংস্কারের কথা বলছে, তার বাস্তবায়ন তাত্ত্বিকভাবে দশ বছরেও শেষ হবে না।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
বিশ্লেষকরা বলছেন— শুধু নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয়েই নয়, রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন এবং ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রসঙ্গেও বিএনপি ও ছাত্রদের অবস্থান পরস্পরবিপরীত। জুলাই মাসে ছাত্রদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন এবং ঘোষণাপত্রের উদ্যোগ নেওয়া হলেও, বিএনপি এটিকে ঠেকিয়ে দিয়েছিল, যা সরকারের সাথে ছাত্রদের সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি করেছে। বিএনপি মনে করেছিল, এই উদ্যোগগুলো আন্দোলনকে বিভক্ত করে দিতে পারে, তবে ছাত্ররা মনে করেছিল, একযোগে কাজ করলে তারা সফল হবে।
বিএনপির বক্তব্য অনুযায়ী, তারা মেনে নিয়েছিল, রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন সংবিধানিক এবং বাস্তবসম্মত নয়। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা তো সংবিধানের অধীনে আছি, সুতরাং রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন করার কথা তাত্ত্বিকভাবে আলোচনা করা খুবই কঠিন।’ তবে নাহিদ ইসলাম বলছেন, ‘আমরা কোনো পছন্দের রাষ্ট্রপতি চাইনি, আমরা শুধু বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে সরে যেতে বলেছিলাম।’
এছাড়া, বিএনপির পক্ষ থেকে ছাত্রদের দল গঠন নিয়ে যে চিন্তা প্রকাশ করা হয়েছে, তাও দলের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘যারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে রাজনীতি করে, তাদের নিষিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। জনগণই ঠিক করবে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কি না।’ নাহিদ ইসলাম এর পাল্টা বলেছেন, ‘কেউ যদি নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, তবে তাকে সরকার ছেড়ে নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে।’
সরকার নির্বাচনের পাশাপাশি বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য সংস্কারেও কাজ করছে, এবং ছাত্ররা কেবল নির্বাচন চায় না, বিচারিক সংস্কারও প্রয়োজন।
অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম
‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ এবং রাষ্ট্রপতি পরিবর্তনের বিষয়গুলো ছাত্রদের মৌলিক দাবির মধ্যে ছিল, তবে বিএনপি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, যা ছাত্রদের কাছে একটি বড় আঘাত ছিল। নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাইছিলাম ছাত্ররা একসাথে এগিয়ে যাক, কিন্তু বিএনপি তা বাধাগ্রস্ত করলো।’
নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে বিএনপির বক্তব্যও আরও স্পষ্ট হয়েছে। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য সরকার যতগুলো সংস্কারের কথা বলছে, তার বাস্তবায়ন তাত্ত্বিকভাবে দশ বছরেও শেষ হবে না।’ অন্যদিকে, নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘সরকার নির্বাচনের পাশাপাশি বিচার বিভাগ এবং অন্যান্য সংস্কারেও কাজ করছে, এবং ছাত্ররা কেবল নির্বাচন চায় না, বিচারিক সংস্কারও প্রয়োজন।’
এছাড়া, রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন এবং নির্বাচনের জন্য বিএনপির চাপ নিয়ে সরকারের অবস্থানও আরও স্পষ্ট হয়েছে। সরকার বারবার জানাচ্ছে, ছাত্রদের দাবির সাথে বিএনপির সহমত হওয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু তা হয়নি। আর ছাত্ররা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে, বিশেষ করে বিএনপির তরফ থেকে ছাত্রদের দাবি সহ্য করতে না পারার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন— বিএনপির বক্তব্যের মধ্যে যে আস্থাহীনতা রয়েছে, সেটিই বর্তমান রাজনৈতিক দূরত্বের মূল কারণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, ‘বিএনপি মনে করছে যে সরকার তাদের ক্ষমতায় আসতে দিচ্ছে না এবং বিলম্বিত করছে, আর ছাত্ররা চিন্তা করছে, ক্ষমতায় এলেও বিএনপি তাদের সংস্কারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে কি না।’
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক বিশ্লেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেটি রাজনৈতিক দূরত্বের মূলভিত্তি।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলেন, সরকারের মধ্যে যখন আস্থাহীনতা থাকে, তখন নির্বাচনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে, কারণ ছাত্রদের মধ্যে বিরোধ এবং সরকারের সাথে ছাত্রদের সম্পর্কের বিভক্তি আরও বাড়তে পারে।
পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যত দ্রুত নির্বাচনের জন্য একটি সঠিক রোডম্যাপ তৈরি করা হবে, ততই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে। অন্যথায়, জনমনে অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়বে, যা দেশের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে। সূত্র: বিবিসি