১৯ জুলাই, শুক্রবার। বাদ জুমা কুলসুম আবারও ফোন করেন। ছেলে কী খেয়েছে জেনে নেন। ফারুক তখন বলে চলেন, কোটার বৈষম্য দূর হলে ফিরবে সাম্য। বিসিএস দিয়ে মিলবে ভালো চাকরি। ঘুচবে অভাব। বাবা আবদুল খালেককেও বছরের পর বছর স্বজন ছেড়ে থাকতে হবে না দুবাই। ছোট ভাই মোহাম্মদ আবদুল্লাহরও সব আহ্লাদ মেটাবেন হাসিমুখে। ভালোভাবে করাতে পারবেন পড়ালেখা। মায়ের চোখেমুখেও নানা স্বপ্নের ঝিলিক। অস্ফুট স্বরে বলেন, ‘বাবা, আন্দোলন করো আর যাই করো, সাবধানে থাকবা।’ মায়ের উদ্দেশে ফারুক বলেন, ‘আম্মা, তুমি বড্ড বেশি টেনশন করো। আমি ভালো আছি, তুমি শুধু শুধু টেনশন করো না।’
মা-ছেলের এ মধুর আলাপন ঠিক ১৫ মিনিট পরই চিরদিনের জন্য থেমে গেছে। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন কবি নজরুল সরকারি কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ওমর ফারুক। সহপাঠীরা তাঁকে নেন স্থানীয় আজগর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তাদের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
কাঁদতে কাঁদতে ফারুকের ভাই মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, মা কথা বলার মিনিট ১৫ পরই ভাইয়ের বন্ধুরা ফোন করে গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানান। আজগর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার আগেই বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ভাই মারা যান। ভাইয়ের বুকে তিনটি গুলি লেগেছে। তাঁকে হারিয়ে মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। দুবাইতে বাবা ভেঙে পড়েছেন। ভাইকে ঘিরেই আমাদের সব স্বপ্ন ছিল।
গত ২১ জুলাই ওমর ফারুকের লাশ দুর্গাপুরের বাকুলজুড়া ইউনিয়নের সিংহা গ্রামে নিয়ে দাফন করা হয়। স্বজনের অভিযোগ, লাশ পেতেও প্রায় দেড় দিন থানায় থানায় ঘুরতে হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থান নিয়ে সূত্রাপুর ও কোতোয়ালি থানা ঠেলাঠেলি করায় এমন হয়েছে। শুধু তাই নয়, ফারুককে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়ার সময় তাঁর দুই বন্ধু এবং কবি নজরুল কলেজ এলাকা থেকে আরেক বন্ধুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা এখনও কারাগারে।
দাফনের পাঁচ দিন পরও কান্না থামছে না মায়ের। কারও সান্ত্বনা কাজে আসছে না। নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন কুলসুম আক্তার। যাকে পাচ্ছেন, তাকে ধরে বিলাপ করছেন, ‘আমার স্বপ্ন সব ভাইঙাচুইরা গেছে। আমার ওমর ফারুক এত কিছু করছে, আমি তো আগে বুঝি নাই। এখন বুঝতেছি। আমার যেমন সম্পদ হারাইল, দেশও তেমন সম্পদ হারাইল। আমার বাবা বাঁইচা থাকলে এখন কত কত মানুষরে রক্ত দিত।’
জানা যায়, ওমর ফারুক সদরঘাটসংলগ্ন এলাকায় মেসে থেকে পড়ালেখা করতেন। স্বেচ্ছাসেবী নানা কাজে নিজেকে যুক্ত রাখতেন। কারও রক্ত লাগবে, ফোন পেলে ফারুক স্থির থাকতে পারতেন না। নিজেই দিতেন অথবা জোগাড় করতেন। দুর্গাপুর ব্লাড ডোনার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন ফারুক।
তাঁর গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী বন্ধু মিরাজ উদ্দিন ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, বিভাগের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে ফারুক ছিল আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। রাজনীতি করত না। কিন্তু কারও বিপদ দেখলে পাশে দাঁড়াত। ১৯ জুলাই চোখের সামনে কত কিছু দেখলাম। সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে ওর মৃত্যু হয়। এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
ফারুকের মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে কবি নজরুল কলেজের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, জুমার পর পুলিশ সদস্যরা খাবার গ্রহণের বিরতিতে যান। আমরাও স্থানীয়দের সহযোগিতায় পানি এবং শুকনো খাবার খাই। খাবার শেষে একটু বিশ্রাম করছিলাম। হঠাৎ পুলিশ লক্ষ্মীবাজারের গলিতে ঢুকে সমানে গুলি ছুড়তে থাকে। সবাই দিগ্বিদিক দৌড়াতে থাকেন। ওই দিন ফারুক ছাড়াও কবি নজরুল কলেজের ইতিহাস বিভাগের জিহাদ এবং অর্থনীতির ছাত্র ইকরাম হোসাইন কাউসার পুলিশের গুলিতে মারা যান।