সমতট ডেস্ক : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুমিল্লায় ৪৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করে আসামি ৩ হাজার ৫৬৫ জন। অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা সাড়ে ৬ হাজার। একই ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটিতে আসামি আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা। আবার অসংখ্য অজ্ঞাত আসামি রাখায় বিরাজ করছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক। অভিযোগ রয়েছে, চার্জশিট থেকে অনেকে নাম বাদ দিতে আর্থিক লেনদেন করছেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তদন্তে গিয়ে তারা কিনারা পাচ্ছেন না। বাদীও চেনেন না আসামিকে। অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীও জানেন না কখন ঘটনা, কেইবা অভিযুক্ত। একই সময়ে ভিন্ন জেলায় মামলা থাকায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। গতি পাচ্ছে না তদন্ত। তবে এজাহারে যত অসংগতিই থাক, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে শুধু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ নাজির আহমেদ খান। তিনি সমকালকে বলেন, ‘মিথ্যা অভিযোগে কেউ গ্রেপ্তার কিংবা হয়রানির শিকার যাতে না হন, পুলিশকে সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
সূত্র জানায়, গত চার মাসে কুমিল্লার বিভিন্ন থানা ও আদালতে যে ৪৬টি মামলা হয়েছে, বেশির ভাগই জুলাই-আগস্ট প্রেক্ষাপটে। সবচেয়ে বেশি ১২ মামলা হয়েছে কোতোয়ালি মডেল থানায়। এ ছাড়া চৌদ্দগ্রামে ২০১৫ সালে আট বাসযাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিল পুলিশ। এ ঘটনায় নতুন করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর মামলা করেছেন বাসমালিক আবুল খায়ের। আসামি করা হয়েছে সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, র্যাবের তৎকালীন ডিজি বেনজীর আহমেদ, কুমিল্লার তৎকালীন পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তীসহ অন্তত ১৯০ জন। এ মামলায় গ্রেপ্তারের পর দুই দফায় রিমান্ড শেষে কারাগারে আছেন শহীদুল হক ও সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএস গোলাম কিবরিয়া মজুমদার।
দুই হত্যাকাণ্ডে চার মামলা
৪ আগস্ট আন্দোলনের সময় দেবিদ্বার উপজেলা সদরে গুলিতে নিহত হন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আবদুর রাজ্জাক রুবেল (৩৫)। ২০ আগস্ট স্থানীয় বিএনপি নেতা আবুল কাসেম আদালতে মামলা করেন। আসামি সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদসহ ৭০ জন। একই ঘটনায় পরদিন আরেকটি মামলা করেন নিহতের মা হাসনে আরা বেগম। আসামি সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ, রাজী মোহাম্মদ ফখরুলসহ ৭০ জন। দেবিদ্বার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহীনুল ইসলাম জানান, জড়িতদের নাম জোড়া দিয়ে তারা দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করছেন।
৪ আগস্ট দাউদকান্দির শহীদ নগরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর গুলিতে মারা যান স্কুলছাত্র রিফাত হোসেন। ১৮ আগস্ট রাজ্জাক ফকির আওয়ামী লীগের ৪৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর দুই সপ্তাহ পর নিহতের মা নিপা আক্তার ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন।
দাউদকান্দি মডেল থানার ওসি জুনায়েদ চৌধুরী জানান, রিফাত হত্যায় আদালতের নির্দেশে পিবিআইতে থাকা মামলার কার্যক্রম স্থগিত আছে। মায়ের অভিযোগ জিডি করা হয়েছে। দুটি একসঙ্গে তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া হবে।
মৃত তিন আ’লীগ নেতা আসামি
জেলার সদর দক্ষিণ মডেল থানায় ২ অক্টোবর মামলা করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এমরান হোসেন। ৯৬ আসামির মধ্যে আওয়ামী লীগের তিন প্রয়াত নেতা রয়েছেন। তারা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কৃষিবিষয়ক সম্পাদক কামাল উদ্দিন মজুমদার, সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মমিন ও উপজেলার পূর্ব জোড়কানন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ওয়াহিদুর রহমান ওরফে ফরিদ। সদর দক্ষিণ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানান, তদন্তে মৃত তিন আসামি পাওয়া গেছে। চার্জশিট থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হবে।
মামলা ভিন্ন জেলায়, আসামি একই কুমিল্লার কোতোয়ালি, সদর দক্ষিণ মডেল থানা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৪ আগস্টের ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। তবে আসামির তালিকা ঘুরেফিরে একই। সদর দক্ষিণের বেলতলী এলাকায় গুলিতে মাছুম মিয়া (২২) নিহতের ঘটনায় ১৮ আগস্ট মামলা করেন আবদুল হান্নান। আসামি কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক এমপি আ ক ম বাহা উদ্দিন বাহার, তাঁর মেয়ে সিটি করপোরেশনের (কুসিক) মেয়র ডা. তাহসীন বাহার সূচনাসহ ৬২ জন। চট্টগ্রামের সদরঘাটের সিটি কলেজের সামনে হামলার অভিযোগে ৪ নভেম্বর মামলা করেন মোমেন হোসেন জয়। ২৬৫ আসামির মধ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের সঙ্গে আছেন ডা. সূচনা।
১৯ জুলাই কুমিল্লা নগরীর দক্ষিণ চর্থা (তালতলা) এলাকায় আন্দোলনে হামলার অভিযোগে সাবেক এমপি বাহার, তাঁর মেয়ে ডা. সূচনাসহ ২২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। একই দিন ঢাকার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হামলার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানায় ২৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন মো. হোসেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আসামি করা হয়েছে বাহার, ডা. সূচনাসহ কুমিল্লার অন্তত ৪০ জনকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, একই দিনে কোনো ব্যক্তির পক্ষে তিন জেলায় হামলা করা কি সম্ভব? এতে প্রমাণ হয় রাজনৈতিক হয়রানি করতে এসব মামলা হয়েছে। তবে কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মহিনুল ইসলাম বলেন, ‘একই স্থানে ভুক্তভোগী আলাদা হলে মামলা করতে পারেন। এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই দিন ভিন্ন জেলায় গিয়ে হামলার অভিযোগে মামলা হলে প্রযুক্তিগত তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’
গ্রেপ্তার আতঙ্ক, নাম কাটতে লেনদেন
এজাহারে নাম না থাকলেও পুলিশ আটক করে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী। কয়েকটি মামলায় বাদী অর্থ নিয়ে আদালতে গিয়ে ভুলের স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন। ফলে আসামি জামিনে বেরিয়ে আসছেন। ৫ অক্টোবর রাতে চান্দিনা মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক এনায়েত উল্লাহ ভূঁইয়া, ৬ নভেম্বর রাতে একই কলেজের অধ্যক্ষ মামুন পারভেজ ও গত ১০ নভেম্বর পিয়ন আল-আমিনকে ধরার পর কোতোয়ালি মডেল থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় ডিবি। অধ্যক্ষ মামুন পারভেজ বলেন, এজাহারে নাম না থাকলেও একটি মহলের নির্দেশে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকটি মামলার একাধিক আসামি জানান, নাম বাদ দিতে বাদী মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করছেন। কেউ কেউ টাকা নিয়ে আদালতে গিয়ে আসামি পক্ষে অ্যাফিডেভিট দিয়ে জামিন করিয়েছেন। তবে কুমিল্লা আদালতের পিপি কাইমুল হক রিংকু বলেন, ‘দু-একটি মামলায় এমন হতে পারে। অনেক ভিকটিম এখনও হাসপাতালে। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বাদী চাইলেও এখন জামিন হচ্ছে না। চার্জশিট পর্যন্ত বিষয়টি আমরা কঠোরভাবে নজরে রেখেছি।’
দেবিদ্বার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সাইফুল ইসলাম শামীমের ভাষ্য, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ভিপি বাবুল এবং তাঁরসহ আট পরিবারের ৩০ সদস্য ২ থেকে ৯ আগস্ট কক্সবাজারে ছিলেন। অথচ ৫ আগস্ট সকালে দেবিদ্বার উপজেলা সদরে সাব্বির হত্যা মামলায় তাদের দু’জনকে আসামি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সাব্বির নিহত হন পুলিশের গুলিতে। ওই সময় আমাদের কক্সবাজার অবস্থানের সব তথ্যপ্রমাণ আছে। পুলিশ তদন্ত করলে সহজেই পেয়ে যাবে। কিন্তু হয়রানি করতেই গণহারে আসামি করা হয়েছে।’