সমতট ডেস্ক : ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লার বুড়িচংয়ে আবারো ঘটলো একাধিক প্রাণহানির ঘটনা। বুধবার (২৩ এপ্রিল) সকালে উপজেলার বাকশিমুল ইউনিয়নের মাধবপুর এলাকায় রেল লাইনের উপর থেকে তিনজনের খন্ডিত মরদেহ করে পুলিশ। এর মধ্যে বিকেল পর্যন্ত মাত্র একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তার নাম সাইফুল ইসলাম। সে এক সময় রংমিস্ত্রির কাজ করলেও এখন ভবঘুরে। থাকতেন কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনে। নিহত অপর দুজনও তার সঙ্গী বলে ধারণা করছে পুলিশ। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তারা তিনজন ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যেতে পারেন।
এর আগে গত বছরের ২৬ নভেম্বর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের বুড়িচং উপজেলার বাকশিমুল ইউনিয়নের কালিকাপুর রেলক্রসিং এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় অটো রিকশার ৭ যাত্রীর মৃত্যু হয় । মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার ছয় মাসের মধ্যেই বুড়িচংয়ের একই ইউনিয়নের পাশাপাশি গ্রামের রেলপথে আবারো তিন জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুধবার সকালে বুড়িচং উপজেলার বাকশিমুল ইউনিয়নের মাধবপুর এলাকায় রেললাইনে হাটাহাটি করার সময় স্থানীয় লোকজন তিনজনের খণ্ডিত মরদেহ দেখতে পান। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি বুড়িচং থানা পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে রেলওয়ে পুলিশকে জানায়।
বুড়িচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক জানান, বুধবার সকালে উপজেলার মাধবপুর এলাকায় তিন যুবকের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখে থানায় খবর দেয় স্থানীয় লোকজন। ধারণা করা হচ্ছে ভোরের দিকে কোনো ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে রেলওয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক সোহেল মোল্লা জানান, রাত আনুমানিক সাড়ে তিনটায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ওই তিন যুবকের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছি। নিহতদের মধ্যে একজনের পরিচয় সনাক্ত করা গেছে। তার নাম সাইফুল ইসলাম। সে তার বাবা মায়ের সাথে কুমিল্লা রেল স্টেশনেই থাকতেন। সাইফুল রংমিস্ত্রির কাজ করলেও সে মাদকাসক্ত হয়ে পরে টোকাই হয়ে যায় বলে আমাদেরকে জানিয়েছে কুমিল্লা রেল স্টেশনের কয়েকজন। এছাড়া সাইফুলের বাবা মোখলেছুর রহমান ও মা আসমা বেগম দুই জনই কুমিল্লা রেলস্টেশনে একটি অস্থায়ী জায়গায় বসবাস করে। তাদেরও নির্ধারিত কোন পেশা নেই।
তিনি বলেন, সাইফুল ছাড়াও লোকমুখে আমরা অপর একজনের নাম তুহিন বলে জেনেছি। তবে কোন ঠিকানা পাওয়া যায়নি। তিনজনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে ঘটনাস্থল কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাকশিমুলের মাধবপুর রেল লাইনের উপরে গিয়ে দেখা গেছে, রেলের স্লিপার ও লাইনের উপর ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। বেশ কয়েক টুকরা টি শার্ট ও দুই জোড়া জুতা পড়ে আছে সেখানে। রেলপথের মাধবপুর এলাকায় ১৬২ নম্বর পিলারের কাছ থেকে তিন যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মাধবপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহেদ আলম বলেন, আমি ভোর ছয়টার দিকে রেল লাইনের পাশে হাঁটতে আসি। এ সময়ে এসে দেখি একজনের মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে আর দুইজনের পা বিচ্ছিন্ন। যাদের পা বিচ্ছিন্ন হয়েছে তাদের মধ্যে একজন তখনও জীবিত ছিল; সে আমার কাছে পানি চায়। কিন্তু গ্রাম দূরে হওয়ায় সে সময় পানি আনার কোন সুযোগ ছিল না। এর মধ্যেই সে মারা যায়। ধারণা করছি ভোর সাড়ে চারটা একে ছয়টার মধ্যে কোন ট্রেন তাদের উপর দিয়ে গিয়েছে।
ফকির বাজার জঙ্গলবাড়ি এলাকার গাড়ি চালক মেহেদী হাসান বলেন, যে তিনজন ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে তারা আশেপাশের গ্রামের কেউ নয়। অনেকেই এসেছেন কিন্তু কেউই তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি। সকাল সাড়ে দশটার দিকে পুলিশ এসে মরদেহগুলো নিয়ে গিয়েছে।
আক্কাস আল মাহমুদ হৃদয় নামে স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, যেখানে তিনজনের মরদেহ পাওয়া গিয়েছে সেখানে একটি পরিত্যক্ত ডাকবাংলো আছে। এখানে অনেকেই মাদক সেবনের জন্য এসে বলে আমরা বিভিন্ন সময়ে খবর পাই। ধারণা করছি তারা এখানে হয়তো ঘুরতে এসেছিল কিংবা মাদক সেবনের জন্য এসেছিল। মাদকাসক্ত অবস্থায় হয়তো তারা ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন। যদিও তাদের ময়নাতদন্তের পর বিস্তারিত বলতে পারবে পুলিশ।
সাইফুলের লাশ দাফনের টাকা তুলছেন বাবা-মা :
এদিকে বুড়িচংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যাওয়া তিন জনের মধ্যে সাইফুলের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় এগিয়ে জানা যায়- সাইফুল এখানেই বাবা-মাসহ ভাসমান মানুষদের সাথে বসবাস করত। বেশ কয়েক বছর ধরেই এখানে থাকা সাইফুল মাঝখানে রংমিস্ত্রির কাজে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার পর সে কাজ ছেড়ে দেয়। গতকাল দুপুরের পর থেকে তাকে আর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় দেখা যাচ্ছিল না। বুধবার দুপুরের পর খবর আসে বুড়িচংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে সাইফুলসহ আরো তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিকেল তিনটার দিকে রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, সাইফুলের বাবা ও মা তার ছেলেকে দাফনের জন্য মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতার টাকা তুলছেন।
সাইফুলের মা আসমা বেগম জানান, ছেলেটাকে যে দাফন করবো সেই খরচের টাকাও নেই। তার বাবাও বাউন্ডেলে। কোনরকম কাজকর্ম করে আমি সংসার চালাই। ছেলেটা কথা না শুনে রংমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে দিয়েছে। গতকাল দুপুরে বের হয়েছে তারপর শুনি রেললাইনে তার মরদেহ পড়ে আছে।
সাইফুলের বাবা মোখলেছুর রহমান বলেন, ময়নাতদন্তের পরে মরদেহ দিলে আমরা দেবিদ্বারে আমার গ্রামে নিয়ে ছেলেকে দাফন করবো।