সমতট ডেক্স ;রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে দুই ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এ ঘটনার মূল টার্গেট ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের ছোট ভাই ওয়াহিদুল হাসান দিপু। তিনি একজন কম্পিউটার ব্যবসায়ী। কিন্তু ভুলক্রমে হামলাকারীরা ব্যবসায়ী এহতেশামুলকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলায় অন্য আসামিদের পাশাপাশি শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল হক ওরফে ইমনকে (৫২) আসামি করা হয়েছে। এছাড়া তার সহযোগী হিসেবে খোকনের নাম মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্যবসায়ী ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ হামলার নেপথ্যে মাল্টিপ্লান এবং আশপাশের ব্যবসায়ীদের গড়া সমিতির দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব। এছাড়া শীর্ষ সন্ত্রাসীর লোকজনদের চাঁদাবাজিও রয়েছে এই হামলার নেপথ্যের কারণ। এহতেশামুল ও দিপু তাদের চাঁদাবাজিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা।
তবে দুই বিষয়কে সামনে রেখেই তদন্ত করছে পুলিশ। এখন পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের থেকে বাকিদের ব্যাপারেও তথ্য মিলবে বলে আশাবাদী পুলিশ।
গত শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) রাতে এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে ব্যবসায়ী ও মাল্টিপ্ল্যান দোকান মালিক সমিতির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. এহতেশামুল হককে রামদা ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করে কয়েকজন। এতে দিপু নামে আরেকজনও আহত হন। এর মধ্যে এহতেশামের অবস্থা গুরুতর। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় ওঠে। কারণ ওই সময় আশপাশে অনেকে থাকলেও কেউ ব্যবসায়ী এহতেশামুলকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। গুরুতর অবস্থায় তিনি একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ফলে তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
হামলার নেপথ্য কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব
আলোচিত এই ঘটনায় শনিবার দুপুরে জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তি চেয়ে মানববন্ধন করেছেন মাল্টিপ্লানের ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে মাল্টিপ্লানের কয়েকজন ব্যবসায়ী রোববার বিকেলে নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, এই হামলার সাথে জড়িত শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন। কারণ তার ইশারায় মাল্টিপ্লানে আগের কমিটি চলত। এই মাল্টিপ্লান থেকে যত টাকা আয় হতো তার সিংহভাগই কমিটির লোকজন আত্মসাৎ করেছেন। এ বিষয়ে বিগত সময়ে ব্যবসায়ীরা ভয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে পারতেন না। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর এই মাল্টিপ্লান ভবন ও এলিফ্যান্ট রোডের ব্যবসায়ীদের সমিতির নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। ফলে আগের লোকজন সরে যান। এতেই চটেছেন সন্ত্রাসী ইমন। তার দখলে থাকা কমিটির লোকজন এখন আর নেই। ফলে তিনি ক্ষিপ্ত।
একাধিক ব্যবসায়ী মনে করেন, এই হামলার নেপথ্যে ইমন ও তার লোকজন জড়িত। ইমনের মনগড়া কমিটির লোকজন এখন পলাতক। তারপরও তিনি নিজের কিছু লোককে দিয়ে কমিটির নেতৃত্ব ধরে রাখতে চান। এটাই কাল হয়েছে বর্তমান কমিটির।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর আগের কমিটির নেতারা এসে বাড়তি চাঁদা দাবি করেন। এতে প্রতিবাদ করেন এহতেশামুল হক ও দিপু। ফলে তাদের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও তার মনঃপূত কমিটির লোকজন। এ কারণে এহতেশামুল হকের ওপর কঠিনভাবে হামলা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
নেপথ্যে দুই সন্ত্রাসীর দখলদারিত্ব
জানা গেছে, মাল্টিপ্লান ও আশপাশের ব্যবসায়ীদের দুটি সংগঠনে গত ১৫ বছর ঢালাওভাবে চাঁদাবাজি হয়েছে। আর এসব করেছেন সমিতি দুটির সাবেক নেতারা। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট ছিল। কিন্তু কেউ মুখ খুলত না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল ও আশরাফুল হক ইমনের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব চলছিল। গত ১৫ বছর ইমনের মনগড়া লোকজন দিয়ে দুটি সংগঠন চলেছে। চলত ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি। তার সিংহভাগই পেতেন ইমন ও তার লোকজন। কিন্তু সেই কামাইয়ে ঘি ঢেলে দেয় ৫ আগস্ট। দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর নতুন নেতৃত্ব আসে। এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি পদে বসানো হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের ছোট ভাই ওয়াহিদুল হাসান দিপুকে। কিন্তু বিষয়টি কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না ইমন। ফলে গত তিন মাস আগে দিপুকে ফোনে নেতৃত্ব ফিরে পেতে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।
মামলার বাদী ওয়াহিদুল হাসান দিপু ঢাকা মেইলকে বলেন, হামলাকারীদের চেনা যায়নি। কারণ তারা বেশির ভাগ ভাড়াটিয়া ছিল।
আর মূলত চাঁদাবাজির জন্যই এই হামলা। এই হামলায় ইমন ও তার লোকজন জড়িত। এটা আমার ভাষ্য নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও বলেন। ইমন গত ৫ আগস্টের পর আমাকে হুমকি দিয়েছিল। তখন আমি কোনো জিডি করিনি।
এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, তখন আমাকে হুমকি দিয়ে ইমন বলেছিল, তার লোকজন কাজ করবে, আমি যাতে কোনো বাধা না দিই।
জানা গেছে, ওয়াহিদুল হাসান দিপু বর্তমানে এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও ই.সি.এস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্লান সেন্টার) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। পাশাপাশি তিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের ছোট ভাই।
টার্গেট ছিলেন দিপু
জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে জামিনে বের হন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল। তিনি বের হয়েই ছোট ভাই দিপুকে এলিফ্যান্ট রোডের নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। বিষয়টি মানতে পারছিলেন না তার চির প্রতিদ্বন্দ্বী শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন।
এলিফ্যান্ট রোড, ধানমন্ডি ও কলাবাগান এলাকার একাধিক সূত্র বলছে, এই হামলায় শীর্ষ ইমনের লোকজন জড়িত। যা মামলার এজাহারেও উল্লেখ করা হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন পিচ্চি হেলালের ভাই দিপুকে টার্গেট করেই তার লোকজনকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ভুলক্রমে তারা প্রথমেই ব্যবসায়ী এহতেশামুলকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে।
এ ব্যাপারে আহত ওয়াহিদুল হাসান দিপু বলেন, তারা আমাকে মারার উদ্দেশে এসেছিল কি না জানি না। তবে তারা আমাকেও হামলা করেছিল। ভাগ্যিস সেদিন বেঁচে গেছি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা যা বললেন
রোববার দুপুরে মাল্টিপ্লানের সামনে কথা হয় প্রত্যক্ষদর্শী ভবনটির নিরাপত্তা কর্মী রাজুর সাথে। তিনি বলেন, সেদিন দিপু স্যারের গাড়ি উঠবে, এজন্য রাস্তার সামনে আমি হুইসেল দিচ্ছিলাম। ঠিক আমার পেছনে তারা ওই সময় এহতেশামুল স্যারকে কোপাচ্ছিল। আমি দেখলাম কয়েকজন লোক একজনকে কোপাচ্ছে। এরপরই দিপুর স্যারের গাড়িকে হাত নেড়ে ইশারা করি যাতে সামনে না আসে। এরপর এক যুবক দৌড়ে এসে তার গাড়িতে কোপানো শুরু করে। পরে দিপু স্যার তার গাড়িটা গ্যারেজে ঢোকাচ্ছিলেন। সেটা দেখে সে পালিয়ে যায়।
ভবনটির গ্যারেজের নিরাপত্তা ইনচার্জ মনির বলেন, ঘটনাটা মাত্র দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে ঘটে যায়। সবার হাতে রামদা ও চাপাতি ছিল। তবে আমরা কাউকে চিনতে পারিনি। তারা এহতেশাম স্যারকে কুপিয়ে ফেলে রেখে সায়েন্সল্যাবের দিকে হেঁটে চলে যায়। এরপর ব্যবসায়ীরা ভবন থেকে নেমে আসে। ততক্ষণে কয়েকজন আহত স্যারকে ধরে পপুলার হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়।
তিনি জানান, যারা হামলা করতে এসেছিল তাদের সবার হাতে চাপাতি ও রামদা ছিল। ফলে আশপাশের লোকজন ভয়ে কেউ ছুটে আসতে পারেনি। এমনকি কেউ সাহসও করেনি।
পুলিশ যা বলছে
এ ঘটনায় নিউমার্কেট থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি করেন আহত দিপু। শনিবার রাতে দায়েরকৃত এই মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনকেও (৫০) আসামি করা হয় বলে জানা গেছে।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- মুন্না (৪৭), একেএম চঞ্চল (৪৩), ইমনের সহযোগী খোকন (৪০), সাঈদ আসাদ (৪১), জসিম ওরফে কলা জসিম (৩৫), তুষার ওরফে কিলার তুষার (৩৫), তৌফিক এহসান (৬৩) ও মো. জাহিদ (৪৪)।
এ বিষয়ে নিউমার্কেট জোনের এসি তারিক লতিফ সামি ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। এ ঘটনায় যে কেউ জড়িত থাকুক না কেন আমরা তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনব। সব বিষয়কে মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে।